অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
মেঘের মধ্যে থাকা ক্ষুদ্র পানিকণার নেগেটিভ ও পজেটিভ চার্জের বৈদ্যুতিক আধান সৃষ্টির মাধ্যমেই বজ্রপাতের সৃষ্টি। ২০১৬ সাল থেকে বজ্রপাত বাংলাদেশে একটি দুর্যোগ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এই দুর্যোগে মৃত্যুর হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। এবারের পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে কালবৈশাখী ঝড় তেমন কাল হয়ে না দাঁড়ালেও কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বজ্রপাত। পুরো মাসে বিশাল সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এই দুর্যোগে।
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত বজ্রপাতে নিহতের সংবাদ তথ্য পর্যালোচনা করেছে অ্যানালাইসিস বিডি। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পুরো বৈশাখ মাসে সারাদেশে বজ্রপাতে নিহত হয়েছে মোট ১৪৭ জন। সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে হবিগঞ্জ জেলায়। সেখানে পুরো মাসে নিহত হয়েছে ২৫ জন। যাদের অধিকাংশ অর্থাৎ ১৫ জনই কৃষক এবং ১২ জনই বানিয়াচং উপজেলার।
বৈশাখের প্রথম দিন ১৪ এপ্রিল ব্যাপক শিলাবৃষ্টি হলেও সেদিন দেশে বজ্রপাতে নিহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে পরেরদিন ১৫ই এপ্রিল পটুয়াখালির গলাচিপায় বজ্রপাতে কালাম হাং (৪৮) নামের এক জেলে নিহত হয়।
এরপর দুইদিন দেশে বজ্রপাতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। বৈশাখের ৪ তারিখ ১৭ এপ্রিল কুমিল্লার দেবিদ্বার ও দাউদকান্দি উপজেলায় পৃথক বজ্রপাতের ঘটনায় নারীসহ ৩ জন নিহত হয়।
৫ বৈশাখ (১৮ এপ্রিল) সারাদেশে বজ্রপাতে নিহত হয় ৬ জন। এদের মধ্যে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় বিল্লাল হোসেন(৩৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। বাকি ৫ জন নিহত হয় হবিগঞ্জে।
৭ বৈশাখ (২০ এপ্রিল) ফেনীর সোনাগাজীতে বজ্রপাতে রকিব উদ্দিন মুন্না (১৩) নামে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্র মারা যায়।
১৬ বৈশাখ (২৯ এপ্রিল) সারাদেশে বজ্রপাতে প্রাণ হারান মোট ১৫ জন। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, কাজিপুর ও কামারখন্দ উপজেলায় বাবা ছেলেসহ পাঁচজন নিহত হয়। মাগুরায় ভ্যানচালক শামীমসহ নিহত হয় ২জন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় মারা যান আবদুর রহিম (৪০) নামে এক কৃষক। এছাড়া নওগাঁয় গৃহবধূ সোনাভান (২৪), গাজীপুরের কালিয়াকৈরে পোশাকশ্রমিক জাফরুল, রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে মনছুরা বেগম (৩৫), নোয়াখালী সদরে স্কুলছাত্র পিয়াল (১৩) ও সুনামগঞ্জ সদরে লিটন মিয়া(৩০) নামে এক কৃষক সেদিন বজ্রপাতে প্রাণ হারায়।
১৭ বৈশাখ (৩০ এপ্রিল) সারাদেশে বজ্রপাতে মারা যায় ১৭ জন। এদের মধ্যে রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁ উপজেলায় স্কুল ছাত্রসহ ৪ জন, রাজশাহীর পুঠিয়া ও গোদাগাড়ীতে দুই কৃষক ও মৌলভীবাজারে প্রবাসীসহ ২ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া রাজবাড়ীতে কৃষক মতিন শেখ, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে শামসুল হক (৩০) ও চুয়াডাঙ্গায় সাদ্দাম হোসেন (২৭) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়।
১৮ বৈশাখ (১ মে) সারাদেশে বজ্রপাতে ১০ জনের প্রানহানি ঘটে। এদের মধ্যে সুনামগঞ্জে দুই শিশুসহ ৪ জন এবং বগুড়ায় মা-ছেলেসহ ৩ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া গাইবান্ধার সাঘাটায় বজ্রপাতে মারা যায় মা ও ছেলে।
১৯ বৈশাখ (২ মে) সারাদেশে বজ্রপাতে শিশুসহ নিহত হয় ৭ জন। এদের সবাই হবিগঞ্জের এবং নিহতদের অধিকাংশই ছিলো কৃষক।
২০ বৈশাখ (৩ মে) একই পরিবারের ৩ সদস্যসহ সারাদেশে বজ্রপাতে নিহত হয় ১৯ জন। মাগুরা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, রাঙামাটি, নোয়াখালী, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গোপালগঞ্জ ও গাজীপুরে এই নিহতের ঘটনা ঘটে।
২১ বৈশাখ (৪ মে) সারাদেশে বজ্রপাতে নিহত হয় ৯ জন। এদের মধ্যে হবিগঞ্জে নিহত হয় তিন জন। এছাড়া সুনামগঞ্জে দিনমজুর জাফর আলী (৪০), কিশোরগঞ্জে মাদরাসাছাত্র শরিফুল ইসলাম (১৫), জামালপুরে শিশু জান্নাতি খাতুন (১২) ও নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে কলেজছাত্র অনয় দেবনাথ (২০) বজ্রপাতে নিহত হয়।
২২ বৈশাখ (৫ মে) বজ্রপাতে নিহত হয় ৩ জন। এদের মধ্যে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে নিহত হন কৃষক মানোয়ার হোসেন (৪৫)। মহেশপুর উপজেলার মির্জাপুরে নিহত হন কাষমিস্ত্রি নির্মল কুমার শর্মা (৩৬)।
২৪ বৈশাখ (৭ মে) সারাদেশে বজ্রপাতে ৯ জনের মৃত্যু ঘটে। নিহতদের মধ্যে চারজনই শেরপুরের। এছাড়া হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় একজন করে মারা গেছেন।
২৬ বৈশাখ (৯ মে) দেশের ১৬ জেলায় বজ্রপাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। এদের মধ্যে হবিগঞ্জে ৬ কৃষক, রাজশাহীর তানোরে কলেজছাত্রসহ ২ জন, নীলফামারীর জলঢাকায় ২ জন, মানিকগঞ্জে স্কুলছাত্রসহ ২ জন, সিরাজগঞ্জে কৃষকসহ ২ জন, কিশোরগঞ্জে নারীসহ ২ জন, জামালপুর ও গাইবান্ধায় ২ কৃষক, নারায়নগঞ্জে ১ স্কুলছাত্রী, চাঁদপুরের কচুয়ায় ১ স্কুলছাত্র, সুনামগঞ্জ ও ধর্মপাশায় ২ কৃষক, কুমিল্লায় ২ জন, গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ২ জন, মুন্সিগঞ্চে ১ কৃষক, ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যান সাইফুল ইসলাম (৩৫) ও খাগড়াছড়িতে মো.নুরুল আলম নামে এক সেনা সদস্য বজ্রপাতে নিহত হন।
২৭ বৈশাখ (১০ মে) দেশের আট জেলায় বজ্রপাতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। নিহতদের মধ্যে কুমিল্লায় সাবেক ইউপি সদস্যসহ চারজন, সাতক্ষীরায় তিনজন, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে স্কুলছাত্রীসহ দুজন, ময়মনসিংহের নান্দাইলে এক কৃষক, নেত্রকোনার বারহাট্টায় এক কিশোরী, নওগাঁর পত্নীতলায় এক কৃষক, মেহেরপুরের গাংনীতে এক কৃষক ও কিশোরগঞ্জের নিকলীতে এক নারী রয়েছেন।
৩০ বৈশাখ (১৩ মে) সারাদেশে বজ্রপাতে নিহত হয় তিনজন। এদের মধ্যে মেহেরপুরের গাংনীতে জিয়াউর রহমান নামে এক দিনমজুর ও ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় ইউনুস শেখ (৪৫) নামের এক কৃষক নিহত হয়েছে। এছাড়া খুলনায় এক কৃষকের মৃত্য ঘটে।
বৈশাখের শেষদিন ৩১ বৈশাখ (১৪ মে) দেশে বজ্রপাতে ১ জনের মৃত্য ঘটে। এদিন ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলায় বজ্রপাতে কৃষক নূর জালাল ফকির (৪৫) নিহত হন।
এছাড়া বজ্রপাতের কারণে আহতের সংখ্যাও কম নয়। বিপুল সংখ্যক গবাদি পশুও মারা গেছে বজ্রপাতের কারণে।
বাংলাদেশে বজ্রপাতে নিহতদের অধিকাংশই কৃষক। হঠাৎ করে বজ্রপাত ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করছে। বজ্রপাতের আতঙ্কে বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটার জন্য কৃষক পাওয়া যাচ্ছেনা বলেও জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাত নামক নতুন এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা ও তা কমানোর জন্য সম্ভাব্য সকল প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহন করা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে বাংলাদেশে বজ্রপাতে সারাদেশে ১৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।