মুসাফির রাফি
মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে বাংলাদেশে বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে প্রতি দুদিনে একজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারী থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই হারেই এই ভয়ংকর অপকর্মটি সংঘঠিত হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, এই ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড করার পরেও আইনশৃংখলা বাহিনীগুলোকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়না, যা তাদেরকে আরো বেপরোয়া করে দিয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানায়, তাদের হাতে এমনও তথ্য আছে যে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ভিকটিমকে তুলে নিয়ে যায় এবং এরকম জোরপূর্বক অপহরনের কয়েকদিনের মধ্যেই পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন যে তাদের পরিজনটি পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে বা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে।
যদিও বাংলাদেশ সরকার বারবারই এই ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের কথা অস্বীকার করছে। একই সংগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও এসব হত্যাকান্ড বন্ধে কার্যকর কোন উদ্যেগ নিতে পারছেনা।
সম্প্রতি জাতীয় এক দৈনিকের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত জানুয়ারী মাসের ১ তারিখ থেকে চলতি এপ্রিল মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত ৪৮ জন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। বছরের প্রথম ৩ মাসেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন ৪২ জন মানুষ।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানায় ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হয়েছে ৪৪টি। যার বেশীরভাগকেই বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে আইনশৃংখলা বাহিনী। অন্যদিকে আরেক মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও শালিস কেন্দ্র’ জানায় গেল ৩ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন ৪৬ জন মানুষ। যার মধ্যে ১৩ জন আটক হওয়ার পর নির্যাতনের কারনে মৃত্যুবরণ করেছেন।
এর আগে গত ৭ এপ্রিল গনমাধ্যমকর্মীদের সাথে মতবিনিময়কালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “বাংলাদেশে কোন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে না। এগুলো সবই বন্দুকযুদ্ধ, যা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তাছাড়া এই ধরনের প্রতিটি অভিযোগেরই তদন্ত হয়েছে। যারা এসব বন্দুকযুদ্ধের সময় উপস্থিত থাকে তাদেরকে তদন্তের স্বার্থে একজন ম্যাজিস্ট্রেট দীর্ঘসময় নিয়ে জেরাও করে থাকে।”
অন্যদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রেজাউল হক বলেন, “তারা বিভিন্ন সময় পত্রিকায় সংবাদ পড়ে এইসব ঘটনার তদন্ত করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়কে চিঠি পাঠান কিন্তু মন্ত্রনালয় তাদেরকে পাল্টা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে এই ধরনের অভিযোগ মোটেও ঠিক নয়। বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ডের কোন ঘটনাই কোথাও ঘটেনি।”
মানবাধিকার কমিশন অবশ্য ২০০৯ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই ধরনের প্রতিটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে তদন্ত করার জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ করেছিলো। তৎকালীন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আমীরুল কবির সেই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছিলেন “প্রতিটি ঘটনাই অন্তত ৩ সদস্যের পৃথক তদন্ত কমিটি দিয়ে তদন্ত করা উচিত। এই ৩ জন সদস্যের একজন নূন্যতম উপসচিব পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা হওয়া বাঞ্ছনীয়। আরেক সদস্য হবেন পুলিশের এসপি সমমর্যাদার এবং তৃতীয় সদস্য হবেন সিভিল সোসাইটির কোন প্রতিনিধি যাকে ভিকটিম পরিবারের সদস্যরা পছন্দ করে দেবেন। আজও পর্যন্ত অবশ্য সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।
অন্যদিকে ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত হাইকোর্ট এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিষয়ে ৩ দফা রুল ইস্যু করেছিলো যা অদ্যবধি মিমাংসিত হয়নি। বেশ কয়েকদফা মহামান্য হাইকোর্ট সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় এবং র্যাবকে কারন দর্শাতে বলেছিলেন যে কেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডকে তারা অবৈধ ঘোষনা করবেননা। কিন্তু এগুলোর কোনটা দিয়েই আসলে কোন কাজ হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। রকিব হাওলাদার নামের ১৫ বছরের একটি বালকও সম্প্রতি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। পুলিশ রকিবকে ছিনতাইকারী হিসেবে আখ্যা দিলেও ১৫ বছরের একটি বালকের এরকম নির্মম হত্যাকান্ডে মানবাধিকার সংগঠনগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
রকিবের মা জানান, তার ছেলেকে ওয়ারী থানা পুলিশ গত ৪ এপ্রিল তুলে নিয়ে যায়। তিনি থানায় গিয়ে ৫ এপ্রিল তার ছেলেকে হাত বাঁধা অবস্থায়ও দেখতে পান। রকিব এই সময় তাকে দেখে মা মা বলে চিৎকার করেছে বলেও তিনি সাংবাদিকদের জানান। অথচ ৬ এপ্রিল শুক্রবার রকিবের মা জানতে পারেন যে রকিব পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। তবে পুলিশ রকিবের মায়ের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ক্রমবর্ধমান বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিষয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এই ধরনের ঘটনা প্রমান করে দেশে আইনের শাসন নেই। কোন দেশে যেখানে আইন আছে, বিচার আছে সেখানে দিনের পর দিন এই ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চলতে পারেনা।