মিরাজ খন্দকার
গতকালের ঢাকা একটু অন্যরকম ছিল। রাস্তাঘাট সব বন্ধ। মানুষরা তাদের গন্তব্যে যাচ্ছেন হেঁটে। চৈত্রের দুপুরে সূর্য যেভাবে থাকে সেভাবেই পূর্ণ শক্তি প্রদর্শন করছিল। ঘর্মাক্ত মানুষেরা ক্লান্ত পায়ে পথ পাড়ি দিচ্ছিলেন আর যারা তাদের পথ আটকে রেখেছে তাদের সমর্থন দিচ্ছিলেন। যৌক্তিক দাবীতে ছাত্ররা আন্দোলন করছে। সব শ্রেণিপেশার মানুষ তাদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে জানা গেল বিকেলে নাকি প্রধানমন্ত্রী সংসদে ভাষন দেবেন এবং সেখানে কোটা বিলুপ্ত করবেন।
বিকেলের সংসদ অধিবেশন ছিল সবার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর। ‘রোমাঞ্চকর’ শব্দটা ব্যবহার করেছি এজন্য যে, ছেলেরা চেয়েছিল কোটা সংস্কার। কিন্তু সেখানে কোটা বিলুপ্ত করার ঘোষণা এসেছে। আবার যারা খুশি হয়ে এই ঘোষণা জানিয়েছে সেই ছাত্রলীগ নেতাদের কোটা সংস্কারের বিরোধী বলেই সবাই জানে। তারা একবার নয় বার বার আন্দোলনরত ছাত্রদের আক্রমণ করেছে। হুমকি ধামকি দিয়েছে। তাই বিকেলে কী হয় এটা নিয়ে সবার কৌতুহলের শেষ ছিল না। সবাই অবশ্য ছাত্রলীগ নেতাদের এই স্টেটমেন্টকে বিশ্বাস করেনি।
প্রধানমন্ত্রী কী বলেন এটা সবার কাছে উৎসুকের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে যেখানে ছিল বিকেলে সবাই টিভির সামনে। প্রধানমন্ত্রীকে বেশ রাগান্বিত দেখা গেলো। একের পর এক হুমকি ও কটু বক্তব্য দিতে লাগলেন। আর স্বৈরাচাররা যা করে তা করতে লাগলেন, বলতে লাগলেন আমি এই দিয়েছি, সেই দিয়েছি, গ্রেডিং সিস্টেম দিয়েছি, আন্তর্জাতিক মানে পড়াশোনাকে উন্নীত করেছি। বলতে বলতে মুখের সকল লাগাম ছিড়ে বললেন ফেসবুক টুইটার এসবও নাকি তিনি ব্যবস্থা করেছেন। তার দেয়া ফেসবুক দিকে তারই বিরুদ্ধে কেন আন্দোলন হচ্ছে এই নিয়ে তিনি বেশ উষ্মা দেখিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন প্রাইভেট সেক্টরে তিনি নাকি চাকরি করার সুযোগ দিয়েছেন ছাত্রদের। তার লাগামহীন বক্তব্যে মানুষ বেশ বিরক্ত হচ্ছিল।
কিন্তু কী আর করা! তিনি তো প্রধানমন্ত্রী। তার কথাইতো আইন। বাধ্য হয়ে সবাইকে শুনতে হচ্ছে। অবশেষে তিনি রাগের মাথায় বললেন যেহেতু কোটা নিয়ে এত কথা এত আন্দোলন তাই কোটা সংস্কার নয়, বাতিলই করে দিলাম। তার এই বক্তব্যে পুরো জাতি কনফিউজড। তিনি কি আসলে কোটা বাতিল করেছেন নাকি অভিমান দেখিয়েছেন, এটা নিয়ে বিশ্লেষন শুরু হয়ে গেলো পুরো দেশে। তবে ঘটনা যাই হোক শেখ হাসিনা পরাজিত হওয়ার মত মানুষ না। আপাত দৃষ্টিতে তিনি কোটা বাতিল করেছেন বলে জানালেও এর ফল যে খারাপও হতে পারে তা ইতিমধ্যে ছাত্ররা টের পেয়েছে।
স্বৈরাচারের দেশে স্বৈরাচারের স্বাদ সবাইকে পেতে হয়। কেউ আগে পায়, আবার কেউবা পরে এই যা। বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতিকদের সবার আগে টের পেতে হয়েছে। এখন পুরো জাতিকে টের পেতে হচ্ছে। ইসলামপন্থীদের এরেস্ট করার জন্য এখন আর কোন আলাদা অপরাধের প্রয়োজন হয় না। তিনি ইসলামপন্থী রাজনীতি করেন এটাই তার গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য যথেষ্ট। একই অবস্থা দিকে পতিত হচ্ছে জাতীয়তাবাদী বিএনপিও। একটা ঠুনকো মামলায় সাজা দিয়ে এরেস্ট করে এখন আমৃত্যু কারাগারের ব্যবস্থা হয়েছে এদেশের এককভাবে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়ার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মত অরাজনৈতিক আন্দোলনও স্বৈরাচারে স্বাদ পেয়েছে এবং আরো পেতে যাচ্ছে। মার্চে আন্দোলন যখন সবে গঠিত হচ্ছে, ছাত্ররা মানববন্ধন, ছোটখাটো সমাবেশ ও সেমিনারের মত প্রোগ্রাম করে যাচ্ছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী বেশ দম্ভের সাথে ঘোষণা করেছেন, কোনো কোটা সংস্কার হবে না। ছাত্ররা এতে দমে না গিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। আট এপ্রিল ছাত্ররা শাহবাগে সমাবেশ করছিল। এতো ছাত্র আন্দোলন করছে এটা তো সরকার জানেন। তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমেও তারা জেনেছেন এতে সব ধরনের ছাত্রদের অংশগ্রহণ আছে। আরো বলতে গেলে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে আছে ঢাবি ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরাই। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আনুগত্যের বাইরে গিয়ে তারা কোটা সংস্কার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। এখান থেকেই সরকারের অনুমান করতে পারা উচিত ছিল কোটা সংস্কার ছাত্রদের গণদাবী।
তারা যে বুঝতে পারে নাই বিষয়টা এমন নয়। বুঝতে পেরেছে এটা বাংলাদেশের সকল ছাত্রদের গণদাবী। কিন্তু রক্তে যখন স্বৈরাচারীর বিষ প্রবেশ করে তখন বিবেক বুদ্ধি কিছুটা লোপ পায়। মানবিকতা হারিয়ে ফেলে। গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। সরকার আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে কোন কর্ণপাত করেনি, আলোচনাতো দূরের কথা। হাসিনা সরকার পুলিশকে ব্যবহার করেছে। পুলিশ দিয়ে হটিয়ে দিতে চেয়েছে আন্দোলনরত ছাত্রদের। এটা করেই বেশ সফল হাসিনা সরকার। গতকালই হাসিনা শিক্ষকের মর্যাদার কথা বলতে গিয়ে একেবারে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি করেছেন। অথচ শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবীতে তিনি শিক্ষকদেরকে পিপার স্প্রে মেরে চোখ নষ্ট করে দিয়েছেন।
যাই হোক ছাত্রদের সরকার পুলিশ দিয়ে হটিয়ে দিতে চেয়েছে। ছাত্ররা মার খেয়েও দৃঢ় অবস্থানে থেকেছে। আট এপ্রিল পুলিশের আক্রমণের পর সব হল থেকে ছাত্রদের গণজোয়ার যখন রাস্তায় নেমেছে তখন পুলিশ পিছু হটেছে। এরপর ছাত্রলীগ কোটা সংস্কার বিরোধী মিছিল করে আক্রমণ করেছে সাধারণ ছাত্রদের উপর। এরপরও ছাত্ররা তাদের অবস্থান সুসংহত রেখেছে। একত্র হয়ে ধাওয়া দিয়েছে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সেক্রেটারিকে। তদুপরি ছাত্রলীগের এমন ন্যাক্কারজনক আচরণে পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে ছাত্রলীগের মধ্যে।
এরপর কিছুটা টনক নড়েছে সরকারের। তবে তারা চাতুরির আশ্রয় নিতে চেয়েছে।ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ইমেজ নষ্ট ও তাদের যৌক্তিক আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উপাচার্যের বাসভবনে ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়। উদ্দেশ্য ছিল এর দায় আন্দোলনকারীদের উপর চাপিয়ে ফায়দা হাসিল করবে। আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিবে। কিন্তু সারাদিন পুলিশের মার খেয়েও অহিংস অবস্থানে থাকা আন্দোলকারীদের গায়ে তারা কলঙ্ক চাপাতে পারেনি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন ফুটেজ যখন পাওয়া গেল তখন দেখা গেল এটা ছাত্রলীগেরই কাজ। তাদের সে প্রজেক্টও মাঠে মারা গেল।
৯ এপ্রিল ১১ টায় আন্দোলনকারীদের সাথে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে বৈঠকের ঘোষণা দিয়েছিল সরকার।এই বৈঠকটাই ছিল আওয়ামীলীগের আন্দোলন দমন করার পরিকল্পনা। সরকারের সাথে ওই আলোচনায় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি হলেন ছাত্রলীগের মহসিন হলের নেতা। অবশ্য তিনি পদত্যাগ করেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেখানে বাঘা বাঘা আওয়ামী নেতা ও পুলিশ অফিসার দিয়ে আন্দোলনকারীদের বাধ্য করা হয় ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করতে।
আলোচনা শেষে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন তারা ৭ মে পর্যন্ত সময় চেয়েছেন। এর মধ্যে কেবিনেট মিটিঙে তারা কোটা সংস্কার নিয়ে যাচাই বাছাই করবেন। ওবায়দুল কাদের কোন আশাব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতিও দেন নি। আলোচনায় ওবায়দুল কাদেরের লাভ ১ মাস আন্দোলন স্থগিত করতে পেরেছেন। আর আন্দোলনকারীদের কোন লাভ হয়নি, কারণ তারা সংস্কারের আশ্বাসটাও আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
আওয়ামীলীগ মূলত চেয়েছিল কোনভাবে আন্দোলন দমিয়ে দেয়া। এরপর আন্দোলনকারী নেতাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলনকে নস্যাৎকরেদেয়া।একদিকেযাচাইবাছাইয়েরজন্যএকমাসসময়নিয়েছেঅন্যদিকেআরেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে দিয়ে হুমকি দেয়ানো হয়েছে। মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, আন্দোলনকারীরা রাজাকারের বাচ্চা। তাদের দেখে নেয়া হবে। একই সাথে হুমকি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেছেন আইসিটি এ্যাক্টে মামলা করা হবে। আরেক মন্ত্রী তারানা হালিমও হুমকি দিয়েছেন। এদিকে অর্থমন্ত্রী আরো আগ বাড়িয়ে বলেন বেসরকারি ভার্সিটিগুলো থেকেও তিনি ভ্যাট নেয়া শুরু করবেন।
এক মাস পর সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়বে রোজার জন্যে। তাই আন্দোলন করার জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এর মধ্যে যারা আন্দোলনকারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের দেখে নেয়া (মতিয়া চৌধুরীর ভাষায়) হবে। ব্যাস আন্দোলন অন্যান্যবারের মতই নিস্তেজ হয়ে যাবে।
এর মধ্যে থেমে থাকেনি ছাত্রলীগ। ঢাকা কলেজসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সিলেক্টিভ সন্ত্রাসীদের জড়ো করেছে ঢাবিতে। ৯ এপ্রিল সারা রাত ধরে বিভিন্ন হলে গিয়ে ছাত্রদের হুমকি দিয়েছে, মারধর করেছে। এভাবেই তারা আন্দোলন দমন করতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের পরিকল্পনাও ভেস্তে গিয়েছে সাধারণ ছাত্রদের দৃঢ়তার কাছে।
এভাবে যখন আন্দোলন দমন করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে তখনই প্রধানমন্ত্রী রাগতস্বরে সেই ভাষণ দিয়েছে। এর ফলে ছাত্রদের সাথে সংশয়ে পড়ে গেছে সারা দেশবাসী। আসলেই কি কোটা বিলুপ্ত হয়েছে? এই প্রশ্ন এখন সবার মনে। আর যদি বিলুপ্ত হয়ও তবে মতিয়া চৌধুরীর ভাষায় আন্দোলনকারীদের দেখে নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের উপর ভিসি ভবনে হামলার দায় চাপিয়ে হুমকি দিয়েছেন প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনা হবে।
তাই আন্দোলনকারীরা এখনো বুঝতে পারেন নি তারা সফল হয়েছেন কী না? তারা আজও সিদ্ধান্ত দিতে পারেন নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল আন্দোলনে যারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে তারা প্রত্যেকে এখন গ্রেপ্তার আতংকে দিন কাটাচ্ছে। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শেষেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের উপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো গতকাল শেখ হাসিনার ভাষণ শেষে শাহবাগ থানায় ছাত্রদের বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে। সবার ভয় এখন সেখানেই। তাই আন্দোলন সফল হলেও আনন্দ মিছিল করতে পারছে না। উল্টো সবাই জীবন আশংকায় ভুগছে। স্বৈরাচারের দেশে আসলে সবাইকেই স্বৈরাচারের স্বাদ পেতে হয়।