আজ ২৫ জানুয়ারি। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কালো দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে জাতীয় সংসদে মাত্র ১১ মিনিটে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি শাসিত এক দলীয় সরকার কায়েম করা হয়।
এদিন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল উত্থাপন করেন। তিনশ’ জন সাংসদের মধ্যে ৬ জন বাদে ২৯৪ জনের সবাই এই বিলের পক্ষে ভোট। আইন ১৯৭৫
বিলটি পাশ হওয়ার পর ওই দিনই শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। এর মাধ্যমে প্রশাসন ব্যবস্থা শেখ মুজিবুর রহমান দেশের নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধিকারী হন। আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে সবরকম ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন।
ভারতের রাজনীতিক জয় প্রকাশ নারায়ণ এক বিবৃতিতে বলেন, মুজিবকে আমরা গণতন্ত্রের বরপুত্র হিসেবে জানতাম। আমাদের ধারণা ইন্ডিয়ার পরামর্শে তিনি এটা করেছেন। তার এ বক্তব্যে সত্যতা মেলে চতুর্থ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার দিনই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অভিনন্দন বার্তার মাধ্যমে।
মূলতঃ মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিগঠনের জন্য জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠনতন্ত্রণ প্রণয়ন না করে ৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের অধীনে নির্বাচিতদের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারই দেশ পরিচালনা করতে থাকে।
ভারতপন্থী এই সরকার সদ্য স্বাধীন দেশের নানা নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে ভারত তোষণের নীতি গ্রহণ করে। ভারতের সঙ্গে একটি ২৫ সালা চুক্তি করে আওয়ামী লীগ সরকার।
ওই চুক্তি মোতাবেক ভারতীয় গঠনতন্ত্রের আদলে বাংলাদেশের জন্য সংবিধান নামে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ও বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য জাতি থাকা সত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংবিধনের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এমনকি সম্পূর্ণ দক্ষিণপন্থী দল হয়েও আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে। এই সংবিধানের মাধ্যমে কার্যত রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর অনুগামী হয়ে পড়ে।
নবগঠিত সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাধরে পরিণত করে।
১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারকে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। এই হত্যার ২২ দিনের মাথায় পচাত্তরের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল কায়েম করা হয়।
বাকশাল কায়েমের মধ্য দিয়ে বাক, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। সব কিছুর উর্ধ্বে বঙ্গবন্ধুর আদেশ-নিষেধ আইনে পরিণত হয়।
একদলীয় শাসন কায়েমের পদক্ষেপকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ হিসেবে উল্লেখ করেন। আর এই দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের মানুষের সব মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার হরণ করেন। অবরুদ্ধ করেন মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা। যদিও এই মহান নেতা ’৭১-এ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি এদেশের মানুষের অধিকার চাই।’
তিনি বাকশালের দর্শন বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন দেশের সবক’টি সংবাদপত্র বিলুপ্ত করেন। শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনায় দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ অবজারভার এবং বাংলাদেশ টাইমস—এ চারটি পত্রিকা সাময়িকভাবে প্রকাশনার সুযোগ দেয়া হয়।
চতুর্থ সংশোধনী বিল পাসের এক মাস পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের মানুষের সব মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার হরণ করেন। এদিন তিনি সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)’ নামে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করেন। একইসঙ্গে নিজেকে এই দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন। পাশাপাশি দল পরিচালনা এবং দলের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও একক ক্ষমতার অধিকারী হন।
বাকশাল কায়েমের মধ্য দিয়ে দেশে বৈধ ১৪টি রাজনৈতিক দলের সব কয়টিই বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ দলগুলো হল- (১) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, (২) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর), (৩) বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), (৪) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), (৫) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, (৬) ইউনাইটেড পিপলস্ পার্টি (ন্যাপ সুধারামী, লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি মোজাফফর ন্যাপের বিদ্রোহী অংশ ও প্রগতিশীল কর্মীগণ), (৭) জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থী কর্মীগণ), (৮) বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, (৯) বাংলা জাতীয় লীগ, (১০) বাংলাদেশ লেবার পার্টি, (১১) জাতীয় গণতন্ত্রী দল, (১২) বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস, (১৩) মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও (১৪) শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী।
বিলুপ্ত ১৪টি দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর) মিলে বাকশাল গঠিত হয়।
এর আগে ওই বছর ৭ জুন বাকশালের গঠনতন্ত্র, কার্যনির্বাহী ও কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পাঁচটি ফ্রন্ট ও এর কার্যনির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় দলের চেয়ারম্যান হিসেবে সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল পদে প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীর নাম ঘোষণা করেন। জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মণি ও আবদুর রাজ্জাককে দলের সেক্রেটারি করা হয়।
আর পাঁচ ফ্রন্ট হলো : জাতীয় কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় মহিলা লীগ, জাতীয় যুবলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ। এর সেক্রেটারিরা হলেন যথাক্রমে ফনী ভূষণ মজুমদার, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, বেগম সাজেদা চৌধুরী, তোফায়েল আহমদ এবং শেখ শহীদুল ইসলাম। ১৫ জনকে নিয়ে কার্যনির্বাহী কমিটি এবং ১১৫ সদস্য রাখা হয় কেন্দ্রীয় কমিটিতে।
১৯৭৫ সালের জানুয়ারীতে সমস্ত রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে যখন বাকশাল গঠিত হয় তখন তিনি খুবই বিরক্ত হন। তিনি বাকশালের বিরোধিতা করাতে তাকে তার সন্তোষের বাড়ীতে অন্তরীণ করে রাখা হয়।
বাকশাল কায়েমের ধারাবাহিকতায় দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। দেশ পরিণত হয় আতঙ্ক ও গুজবের দেশে। রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাচারিতার দেখাদেখি ক্ষমতার উষ্ণতায় থাকা সামরিক-বেসামরিক নানা গোষ্ঠী কার্যত দুর্বৃত্তে পরিণত হন। তাদেরই একাংশ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে।
এর মধ্য দিয়ে কার্যত বাংলাদেশ নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতায় বসলেও তার দুর্বল নেতৃত্বে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারানোর ঝুঁকিপূর্ণ দিন পার করছিল বাংলাদেশ।
এর মধ্যেই ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ক্যু সংঘটিত হয়। খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে বসান খালেদ মোশাররফ। অভ্যুত্থানের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়। অন্যদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত হন জাতীয় চার নেতা।
ওই সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে তার মদদ দিয়েছে রাশিয়া ও ভারত। এতে সকল সেনা শিবিরসহ সারা দেশেই প্রচণ্ড ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
খালেদ মোশাররফ ছিলেন মুক্তিযু্দ্ধের একজন মহান সেনাপতি ও অবিসংবাদিতভাবে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী উপ-সেনাপ্রধান। কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করে খালেদ নিজেই সেনাপ্রধান হওয়ায় ও তার স্বজনদের নেতৃত্বে নিহত বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মিছিল করার ঘটনায় তার সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েন সাধারণ সৈনিক ও দেশপ্রেমিক জনতা।
৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিল। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ৬ নভেম্বর দিনগত মধ্যরাতে সিপাহীরা বিদ্রোহ করে এক অসামান্য বিপ্লবের সূচনা করেন।
২য় ফিল্ড আর্টিলারির সৈন্যরা মেজর মহিউদ্দিন এবং সুবেদার মেজর আনিসুল হকের নেতৃত্বে হাজার হাজার সাধারণ সৈনিক জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দিদশা থেকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদর দপ্তরে নিয়ে আসেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওইদিনই সেনানিবাসে এক বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার জন্য একটি প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও তিনজনকে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তিনজন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হলেন- তিন বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল এম. জি. তাওয়াব এবং রিয়ার এডমিরাল এম. এইচ. খান।
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়। এর দুদিন পরে ৪ এপ্রিল তৎকালীন সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল উত্থাপন করেন। বিলটি ২৪১-০ ভোটে পাশ হয়, ৫৯ জন সাংসদ বিলটিতে ভোটদানে বিরত ছিল। এর মধ্য দিয়ে সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ বাকশাল থেকে ফের বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে প্রত্যাবর্তন করে।
সূত্র: অনলাইন বাংলা