অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
রংপুরে এক হিন্দু ছেলে কর্তৃক ইসলাম ধর্ম ও নবীকে কটুক্তি করে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করার প্রতিবাদ ও অভিযুক্তকে গ্রেফতারের দাবিতে মুসল্লি ও এলাকাবাসীর সঙ্গে গত শুক্রবার পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ ও হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসময় পুলিশের গুলিতে অন্তত ৩ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হয়েছে। আজ শনিবার এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে নাসিরনগর ও রামুর ঘটনার ন্যায় এই ঘটনায়ও হিন্দু বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো প্রমান ছাড়াই জামায়াত শিবিরকে দায়ী করা হয়েছে। নাসিরনগর ও রামুর ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একইভাবে জামায়াত শিবিরকে দায়ী করা হলেও পরবর্তীতে তদন্তে এসব ঘটনার পেছনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতার প্রমান মিলেছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে এই ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করা হলেও অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ঘটনার আসল তথ্য। রামু ও নাসিরনগরের ন্যায় এই ঘটনায়ও উত্তেজিত সাধারণ জনতাকে আওয়ামী লীগের নেতাদেরকেই নেতৃত্ব ও উস্কানি দিতে দেখা গেছে।
অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৮ অক্টোবর শ্রী টিটু চন্দ্র রায় তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ সা: কে কটুক্তি করে পোষ্টটি করেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে পোষ্ট করায় ৬ নভেম্বর স্থানীয় কিছু মুসল্লি থানায় যায় টিটুর বিরুদ্ধে মামলা করতে। কিন্তু প্রথমে পুলিশ মামলা গ্রহন না করলে মুসল্লিরা চলে আসে। পরে মুসল্লিদেরকে থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে মামলা গ্রহন করে পুলিশ। মামলা গ্রহনের পর মুসল্লিরা টিটুকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশকে ২৪ ঘন্টা আলটিমেটাম দিয়ে আসে এবং এই সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা না হলে তারা আন্দোলনের হুমকিও দেয় পুলিশকে।
৭ নভেম্বর আল্টিমেটামের সময় শেষ হয়ে গেলে মুসল্লিরা শ্রী টিটু চন্দ্র রায়ের গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করে। সেই সমাবেশে নেতৃত্ব ও বক্তৃতা প্রদান করেন রংপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ এর যুগ্ম আহবায়ক হালিমুল হক, হরিদেবপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ এর সেক্রেটারি সাইদুল ইসলাম, হরিদেবপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি শাহজাদা ইসলাম জয়, হরিদেবপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সেক্রেটারি এজাজুল ইসলাম রাজুসহ স্থানীয় আরো কয়েকজন নেতৃবৃন্দ।
এদিকে পুলিশ ৩ দিনেও টিটুকে গ্রেফতার না করায় ৯ নভেম্বর মুসল্লিরা ফের সমাবেশের আয়োজন করে। সেই সমাবেশ থেকে মুসল্লিরা পুলিশকে আরো একদিনের আল্টিমেটাম ও শুক্রবার বিশাল সমাবেশের ঘোষণা দেয়।
শুক্রবার পুরো এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করলে অনাকাঙ্খিত ঘটনা রুখতে জুমার নামাজের সময় পাগলাপীরসহ আসপাশের এলাকাগুলো পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। পরে পাগলাপীর বাজারে সমাবেশ করতে না পেরে অল্প কিছু মুসল্লি, প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সেই সংখ্যাটি প্রায় তিনশ’র মত হবে, যারা পাগলাপীর সংলগ্ন সলেয়াশা বাজারে মানববন্ধন করে চলে যায়। মুসল্লিরা চলে যাওয়ার পর পাশ্ববর্তি কয়েকটি ইউনিয়ন থেকে প্রায় দশ থেকে পনের হাজার মানুষ লাঠি সোঠাসহ রাস্তায় অবস্থান নেয় এবং মানববন্ধন করে। তবে এসময় তাদের নেতৃত্বে তেমন কোনো পরিচিত নেতাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এক পর্যায়ে কিছু সংখ্যক লোক পাশ্ববর্তি একটি হিন্দু পল্লীতে হামলা চালায়।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সাধারণ জনতার ঐ হামলায় হিন্দু বাড়িগুলোর খুব সামান্যই ক্ষতি হয়। তারা শুধু লাঠি সোঠা দিয়ে ঘর বাড়িতে আঘাত করে। কিন্তু সাধারণ জনতার উপস্থিতিতেই এক ব্যক্তি মোটর সাইকেলে করে এসে হিন্দুদের ঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। হিন্দুদের ঘরে আগুন লাগানো সেই ব্যক্তি সাদা পোশাকে পুলিশের লোক ছিলো বলেই দাবি করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অ্যানালাইসিস বিডিকে আরো জানান, মোটর সাইকেলে করে এসে যখন ঐ আগন্তুক হিন্দুদের ঘরগুলোতে আগুন দিচ্ছিলেন তখন তার সঙ্গে ছিলেন ঐ এলাকারই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা পলাশ চন্দ্র রায়। হিন্দু বাড়িতে আগুন ধরানোর পেছনে এই পলাশ চন্দ্র রায়কেই প্রধান কারিগর হিসেবে মনে করেন স্থানীয়রা। তার সহযোগীতায়ই সাদা পোশাকের পুলিশের লোক হিন্দুদের ঘরে আগুন দেয় বলে তাদের দাবি।
এদিকে কিছু সংখ্যক মানুষ আরো কিছু হিন্দু বাড়িতে হামলা করে চলে যাওয়ার সময় পুলিশ তাদের উপর গুলি চালালে দুইপক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় পুলিশের গুলিতে হাবিবুর রহমান (২৬) ও সিএনজি চালক হামিদুল ইসলাম (৩০) সহ ৩ জন নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে ও সংঘর্ষে আহত হয় প্রায় ৪০ জন। এরমধ্যে ১৫ জন শুক্রবার রাতেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে যায় এবং ২৫ জন এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এদের মধ্যে ৭ জন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রামু ও নাসিরনগরের ঘটনায় টার্গেট ছিলো সংখ্যালঘু রাজনীতিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা আদায়। রংপুরের ঘটনাও ভিন্ন কোনো ঘটনা নয়। প্রমাণ ছাড়াই পুলিশ কর্তৃক একটি নির্দিষ্ট দলকে দোষারোপ করাই প্রমান করে এই ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত ও রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের চক্রান্ত। রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের সমর্থন আদায়ের জন্য এটি সরকার দলীয়দের ঘৃণ্য কৌশল বলেও মনে করেন অনেকে। তবে নাসিরনগর ও রামুর ন্যায় এই ঘটনায়ও জড়িত প্রকৃত দোষীদের ছবি ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে বলেই মনে করেন তারা।
Discussion about this post