মো. এবাদুর রহমান শামীম
সম্প্রতি [সেপ্টেম্বর ২০১৭] প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষকের গবেষণাকর্মে বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তির [Plagiarism] ঘটনা সিটিজেন ও নেটিজেন উভয় দুনিয়ায় ঝড় তুলেছে। ঢাবি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সামিয়া রহমান ও অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের Social Science Review জার্নাল (ডিসেম্বর, ২০১৬) সংখ্যায় প্রকাশিত [A New dimension of Colonialism and Pop Culture: A case study of the Cultural Imperialism] আর্টিকেলে চৌর্যবৃত্তি/প্ল্যাজারিজমের আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি University of Chicago Press এই দু’শিক্ষকের বিরুদ্ধে ঢাবি কর্তৃপক্ষের নিকট Chicago Journal -এ প্রকাশিত ফরাসি দার্শনিক Paul-Michel Foucault এর লেখা The Subject and Power [Critical Inquiry- 1982] আর্টিকেল প্ল্যাজারিজম/চৌর্যবৃত্তির লিখিত অভিযোগ করেছে। এমনকি Said Academy of Palestine ঐ শিক্ষকদ্বয়ের বিরুদ্ধে প্রখ্যাত মার্কিন দার্শনিক ও গবেষক Edward Said (Born in Palestine] এর লেখা Two Visions in the Heart of Darkness, consolidated vision and Overlapping Territories, Intertwined Histories [Culture and Imperialism1993] গবেষণাকর্ম চৌর্যবৃত্তি/প্ল্যাজারিজমের অভিযোগ এনেছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ঢাবি কর্তৃপক্ষ ড. নাসরীম আহমাদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করেছে।
প্ল্যাজারিজম হলো অন্যের মেধা, চিন্তা-চেতনা, অভিব্যক্তি, ভাষা ও লিখনশৈলী, শিল্পকর্ম ও অর্জন হুবহু কিংবা কিছুটা সংযোজন-বিয়োজন করে নিজ কর্ম বলে চালিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস। প্ল্যাজারিজম/বুদ্ধিবত্তিক চৌর্যবৃত্তি একটি মারাত্মক নৈতিক অপরাধ; যা কপিরাইট/মেধাসত্ত্ব আইনের লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য। এটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে। এই ধরণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানা, স্থগিতাদেশ এমনকি বহিষ্কারাদেশের মতো শাস্তি হতে পারে। চৌর্যবৃত্তি বা প্ল্যাজারিজমের মাধ্যমে নিজ নামে চালিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তচর্চার প্রবাদ পুরুষরা বরাবরই মুন্সিয়ানার পরিচয় দেখিয়েছে। মুক্তমনা-বিজ্ঞানমনস্ক প্রগতিশীলদের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তচর্চার চৌর্যবৃত্তি একটা শিল্পকর্মও বটে। ধর্ম ও সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনীতি – সবক্ষেত্রেই তাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তচর্চার নামে চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছে। তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তচচর্চা তথা সাহিত্যকর্ম, চলচ্চিত্র নির্মাণ, গবেষণাকর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের নামে চেতনাবাজি সবই চৌর্যবৃত্তির ফসল। বিদেশি শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও গবেষণা কর্ম ভাবানুবাদ কিংবা সংযোজন-বিয়োজন করে নিজ নামে চালিয়ে তাঁরা হয়ে যায় তথাকথিত প্রথাবিরোধী ও মুক্তমনা-বিজ্ঞানমনস্ক প্রগতিশীল লেখক, গবেষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। নারীবাদী সাহিত্যকর্মের নামে চরম অশ্লীল/যৌন সুড়সুড়িতে ভরপুর সাহিত্য, ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীলতার নামে ইসলাম ধর্ম বিদ্বেষ, অসাম্প্রদায়িকতার নামে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও চেতনার নামে আয়নাবাজি অসভ্য, রুচিহীন, ইতর ও যৌন বিকারগ্রস্ত মুক্তমনা-বিজ্ঞানমনস্ক ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীলদের সাহিত্যকর্মের প্রধান উপজীব্য । এককথায় সব ধরণের কর্মে অবাধ যৌনতা ও ইসলাম ধর্মবিদ্বেষী মনোভাব বারংবার ফুটে উঠেছে। ২০১২ সালে তথাকথিত মুক্তমনা-বিজ্ঞানমনস্ক প্রগতিশীলদের বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তচর্চার মুখোশ উন্মোচিত হয়। এই সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে শাহবাগী ধর্মনিরপেক্ষ-প্রগতিশীলদের চেতনার চৌর্যবৃত্তির কুৎসিত রূপ গোটা জাতি অবলোকন করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তমনা-বিজ্ঞানমনস্ক ও ধর্মনিরপেক্ষ-প্রগতিশীল তথা শাহবাগী চেতনার ফেরিওয়ালাদের কাছে দেবতুল্য নাম ড. হুমায়ুন আজাদ ও ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
হুমায়ুন আজাদ [১৯৪৭-২০০৪]
হুমায়ুন আজাদ ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং রাজনীতিক ভাষ্যকার। তিনি বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক যিনি ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কার বিরোধিতা, নিরাবরণ যৌনতা, নারীবাদ, রাজনৈতিক এবং নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য ১৯৮০’র দশক থেকে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর নারী(১৯৯২), দ্বিতীয় লিঙ্গ (২০০১) এবং পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৪) গ্রন্থ তিনটি বিতর্কের ঝড় তোলে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।
হুমায়ুন আজাদ ছিলেন স্বঘোষিত নাস্তিক। তাঁর অন্যতম প্রণোদনা ছিল প্রথা-বিরোধিতা। কবিতা, উপন্যাস ও রচনা সর্বত্রই তিনি প্রথাবিরোধী ও সমালোচনামুখর। সর্বপ্রথম গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের আদলে ১৯৯১ প্রকাশিত প্রবচনগুচ্ছ এদেশের শিক্ষিত পাঠক সমাজকে আলোড়িত করতে সক্ষম হয়েছিল। জীবনের শেষার্দ্ধে অকুতোভয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, সামরিক শাসনের বিরোধিতা, নারীবাদী বক্তব্য এবং একই সঙ্গে নিঃসংকোচ যৌনবাদিতার জন্যে তিনি ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অভীষ্ট তাঁর সাহিত্যকে প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত করেছিল। লেখার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তীব্র আক্রমণের কারণে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হত্যা প্রচেষ্টার শিকার হন। তাঁকে ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। [উইকিপিডিয়া]
কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী। ভাষাশৈলীতে তিনি বুদ্ধদেব বসু-র দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁর স্বকীয়তা অনস্বীকার্য। তাঁকে দেশের প্রধান প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক লেখক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তিনি জনপ্রিয় তবে অতি বিতর্কিত সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি যা ভাবতেন তাই সাহসের সঙ্গে লিখতেন ফলে তিনি অনেকেরই বিরাগভাজন হন। এক পর্যায়ে তিনি মৌলবাদীদের কর্তৃক মারাত্মকভাবে আহত হয়ে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েন। তাঁর নারী (১৯৯২), দ্বিতীয় লিঙ্গ (২০০১), পাক সার জমীন সাদ বাদ (২০০৩) গ্রন্থ তিনটি বিতর্কের ঝড় তোলে এবং এরই এক পর্যায়ে সরকার বই তিনটিকে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে।[বাংলাপিডিয়া]
হুমায়ুন আজাদের চৌর্যবৃত্তির কিছু স্বরূপঃ
নারী [১৯৯২]
হুমায়ুন আজাদের নারী গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে একমাত্র তথ্যসংবলিত পূর্ণাঙ্গ নারীবাদী বই। এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ নারীবাদী গ্রন্থ ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।[উইকিপিডিয়া]
তাঁর এই অমর ও মৌলিক গ্রন্থ আমেরিকান নারীবাদী লেখক ও দার্শনিক Kate Millet এর লেখা (PhD গবেষণার উপর ভিত্তি করে) Sexual Politics (1970) গ্রন্থের সাথে হুবহু মিল রয়েছে।
[আহমদ ছফা, মানবজমিন, ১৯৯৮ এবং হুমায়ন আজাদ ও কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ, শিবলী আজাদ]
বাক্যতত্ত্ব [১৯৮৪]
ভাষাবিজ্ঞানের উপর তাঁর লিখিত মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ। গ্রন্থটি মূলত PhD গবেষণার ভিত্তিতে লেখা। বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত হয়।তিনি প্ল্যাজারিজম বা চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে লিখেছেন প্রমাণিত হওয়ায় বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।
[আহমদ ছফা, মানবজমিন, ১৯৯৮ এবং হুমায়ন আজাদ ও কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ, শিবলী আজাদ]
শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ [১৯৮৮]
তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি স্প্যানিশ দার্শনিক Jose Ortega y Gasset এর লেখা La deshumanización del arte e Ideas sobre la novela (The dehumanization of art and Ideas about the novel-1925) গ্রন্থ থেকে নকল করে লিখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
[আহমদ ছফা, মানবজমিন, ১৯৯৮ এবং হুমায়ন আজাদ ও কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ, শিবলী আজাদ]
আমার অবিশ্বাস [১৯৯৭]
একটি দর্শন গ্রন্থ। নোবেলজয়ী ব্রিটিশ লেখক ও দার্শনিক Bertrand Russell এর লেখা Why I Am Not a Cristian (1927) এবং Ibn Warraq (জন্ম ভারতে হলেও ১৯৪৭ সপরিবারে পাকিস্থান চলে যান) এর Origins of the Koran(1995) ও Why I Am Not a Muslim (1995) গ্রন্থসমূহের অনুকরণে লিখেছেন বলে অনেকে মনে করেন।
[আহমদ ছফা, মানবজমিন, ১৯৯৮ এবং হুমায়ন আজাদ ও কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ, শিবলী আজাদ]
জলপাই রঙের অন্ধকার [১৯৯২]
তাঁর রচিত একটি সমালোচনা গ্রন্থ। পাকিস্তানি লেখক ও ঔপন্যাসিক Tariq Ali’র Can Pakistan Service? The Death of a State(1983) এর অনুকরণে লেখা বলে ধরা হয়।
[আহমদ ছফা, মানবজমিন, ১৯৯৮ এবং হুমায়ন আজাদ ও কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ, শিবলী আজাদ]
নিবিড় নীলিমা[১৯৯২]
সমালোচনা গ্রন্থ। এটিও পাকিস্তানি লেখক ও ঔপন্যাসিক Tariq Ali’র Stalinist Legacy: Its Impact on 20th Century World Politics গ্রন্থের আদলে রচিত বলে অভিযোগ রয়েছে।
[আহমদ ছফা, মানবজমিন, ১৯৯৮ এবং হুমায়ন আজাদ ও কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ, শিবলী আজাদ]
দ্বিতীয় লিঙ্ক[২০০১]
মৌলিক গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি ফরাসি নারীবাদী লেখক ও দার্শনিক Simone de Beauvoir এর লিখিত The Second Sex (French: Le Deuxième Sexe-1949) গ্রন্থের সাথে হুবহু মিল রয়েছে।
[আহমদ ছফা, মানবজমিন, ১৯৯৮ এবং হুমায়ন আজাদ ও কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ, শিবলী আজাদ]
হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ [১৯৯২]
তাঁর রচিত প্রবচন সংকলন। এই সংকলনে সর্বমোট ২০০টি প্রবচন যুক্ত হয়েছে। তাঁর লেখা প্রবচনগুচ্ছের অধিকাংশ ফরাসী দার্শনিক Duc de La Rochefoucauld এর Maxims গ্রন্থ থেকে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
[হুমায়ন আজাদ ও কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ, শিবলী আজাদ]
পাক সার জমিন সাদ বাদ [২০০৪]
বাংলাদেশের অন্যতম প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ রচিত একটি উপন্যাস। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতাকারী একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপর ভিত্তি করে এটি রচিত হয়। উপন্যাসটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় উঠে। আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকার উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। লেখক হুমায়ূন আহমেদ এই উপন্যাসকে কুৎসিত বলে মন্তব্য করেন।[উইকিপিডিয়া]
২০০৮ সালে ১৮ জুলাই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ সুইডেনে অবস্থানকালে সাব্বির রহমান খান তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। যা দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন আহমেদ একপর্যায়ে দাবি করেন, বাংলাদেশের লেখকরা স্বাধীন। তাহলে হুমায়ুন আজাদকে মরতে হলো কেন? এই প্রশ্নের জবাবে হুমায়ুন আজাদের এককালের বন্ধু ও সহকর্মী হুমায়ূন আহমেদ বলেন, কারণ যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিত যে, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয় না।
[বিডিনিউজ২৪, ১৮ জুলাই, ২০০৮]
আমার মুক্তিযুদ্ধ[২০০৬]
তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ।”……এ ঘটনার নাম আমি দিয়েছি আমার মুক্তিযুদ্ধ। আমি পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করেছিলাম একাত্তরের কয়েক বছর পর, বাঙলাদেশ থেকে সুদূর এডিনবরায়।
[আমার মুক্তিযুদ্ধ নামক লেখাটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল খবরের কাগজ এ, ২০ মার্চ ১৯৯৩ সালে। পরবর্তীতে ২০০৬ সালের একুশে বইমেলায় তাঁর অনেকগুলো লেখার সংকলন বই আকারে আমাদের বইমেলা নামে প্রকাশিত হয়।]
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। শাহবাগী চৌর্যবৃত্তিক চেতনার ফেরিওয়ালাদের কাছে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আপোষহীন সিংহপুরুষ নামে সুখ্যাত।
বাংলা একাডেমী কর্তৃক গ্রন্থ নিষিদ্ধককরণঃ
কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ও পশ্চিমবঙ্গ ভাষাতত্ত্ব সমিতির সভাপতি মৃনাল কান্তি নাথ ১৯৮৯ সালে চতুরঙ্গ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেন যে, হুমায়ন আজাদের বাক্যতত্ত্ব বইটি আদতে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ৩ খণ্ডের দি অরিজিন এন্ড ডেভেলপম্যান্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রন্থের চারটি অধ্যায়ের লাইন বাই লাইন অনুবাদ। সুনীতিকুমারের এস্টেট মামলা করার আইনী নোটিশ পাঠালে ঢাকার বাংলা একাডেমী তড়িঘড়ি করে বাংলার অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে সভাপতি করে তিন সদস্যের একটি রিভিউ কমিটি করে। কমিটির সুপারিশ অনুসারে বাংলা একাডেমী বাক্যতত্ত্ব বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়।
হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে তাঁর সমমনা ও সমসাময়িক আহমদ ছফা ও জনৈক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিবলী আজাদের মূল্যায়নঃ
আহমদ ছফা [১৯৪৩ – ২০০১]
আহমদ ছফা একজন বাংলাদেশি লেখক, কবি ও সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবী তিনি। তাঁর লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি ২০০২ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদকলাভ করেন। জীবদ্দশায় আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধী, নির্মোহ, অকপট দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ছিলেন। তাঁকে ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।[উইকিপিডিয়া]
হুমায়ুন আজাদ এবং তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তির ইতিবৃত্ত নিয়ে আহমদ ছফার একটি নিবন্ধ ১ ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালে মানবজমিনে প্রকাশিত হয়। এই নিবন্ধে তিনি হুমায়ুন আজাদকে অহংকারী, মিথ্যুক, স্ট্যান্ডববাজ, পরশ্রীকাতর ও রুচিহীন নির্লজ্জ মানুষ এবং প্ল্যাজারাইজড লেখক হিসেবে আখ্যা দেন এবং তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তির প্রমাণও তুলে ধরেন।
শিবলি আজাদ [Shibly Azad]
Lecturer, Department of English
Lehman College, New York, USA
Assistant Professor [Study Leave], University of Development Alternative [UODA], Dhaka
B.A. [University of Science and Arts of Oklahoma & Columbia University]
M.A. [Lehman College]
শিবলি আজাদ বাংলাপিডিয়ার সম্পাদনার সাথেও যুক্ত ছিলেন। হুমায়ুন আজাদ ও কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ নিবন্ধে তিনি প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ রচিত নারী, বাক্যতত্ত্ব, ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান, শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, দ্বিতীয় লিঙ্গ, আমার অবিশ্বাস ও হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধগুচ্ছ প্রভৃতি গ্রন্থের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আনেন এবং তথ্য-প্রমাণাদি তুলে ধরেন। তিনি দাবি করেন, তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলোর প্রথম এডিশন লাইন বাই লাইন অনুবাদ। পরবর্তী এডিশনগুলোতে কিছু পরিবর্তন-পরিমার্জন করে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মাত্র।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল [জন্মঃ ২৩ ডিসেম্বর ১৯৫২]
মুহম্মদ জাফর ইকবাল হলেন একজন বাংলাদেশী লেখক, পদার্থবিদ ও শিক্ষাবিদ। তাকে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখা ও জনপ্রিয়করণের পথিকৃৎ হিসাবে গণ্য করা হয়। এছাড়াও তিনি একজন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক এবং কলাম-লেখক। তার লেখা বেশ কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। তিনি বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং তড়িৎ কৌশল বিভাগের প্রধান।[উইকিপিডিয়া]
বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হলেও তাঁর বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ রয়েছে। সচেতন পাঠকমহল মনে করেন তাঁর অনেক লেখা বিদেশি গল্প, সিনেমা ও কল্পকাহিনীর ছায়া অবলম্বলে রচিত। স্বঘোষিত নাস্তিক না হলেও তিনি সরাসরি ইসলাম ধর্মবিদ্বেষী। যা তাঁর লেখনী ও বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বিভিন্ন সময়ে ফুটে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। মহান মুক্তি সংগ্রামে তিনি অংশগ্রহণ করেন নি। শাহবাগী চৌর্যবৃত্তিক চেতনার ফেরিওয়ালাদের কাছে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আপোষহীন দেবতুল্য জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে পূজনীয়।
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের চৌর্যবৃত্তির কিছু স্বরূপঃ
কপোট্রনিক সুখ দুঃখ [১৯৭৬]
তাঁর প্রথম সায়েন্স-ফিকশন গল্প কপোট্রনিক ভালোবাসা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটি পড়ে একজন পাঠক দাবি করেন সেটি বিদেশি গল্প থেকে চুরি করা। এর উত্তর হিসেবে তিনি একই ধরণের বেশ কয়েকটি বিচিত্রার পরপর কয়েকটি সংখ্যায় লিখে পাঠান। তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে এই গল্পগুলো নিয়ে কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। [উইকিপিডিয়া]
ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম [১৯৮৮]
একটি জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন গ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রখ্যাত ইংলিশ ফিল্ম ডিরেক্টর Ridley Scott পরিচালিত Alien [Created by Dan O’Bannon & Ronald Shusett-1979] ফিল্ম থেকে চৌর্যবৃত্তি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিতু ও তার বন্ধুরা [১৯৯৯]
একটি জনপ্রিয় কিশোর উপন্যাস। খ্যাতিমান আমেরিকান ফিল্ম ডিরেক্টর ও কমেডি অভিনেতা Danny DeVito পরিচালিত শিশুতোষ ফ্যান্টাসি কমেডি ফিল্ম Matilda [1996- Based on Roald Dahl’s Novel of the Same Name] এর সাথে মিল রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স
একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ। নোবেল বিজয়ী মার্কিন পদার্থ বিজ্ঞানী Richard Phillips Feynman জনপ্রিয় বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ QED: The Strange Theory of Light and Matter [1985] থেকে অবিকল ভাষান্তর করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মেকু কাহিনী [২০০০]
একটি কিশোর উপন্যাস। আমেরিকান ফিল্ম ডিরেক্টর ও প্রডিউসার Patrick Read Johnson পরিচালিত Baby’s Day Out [1994- written by John Hughes] নামক শিশুতোষ ফিল্মের সাথে হুবহু মিল রয়েছে বলে অনেক পাঠক দাবি করেছেন।
অবনীল [২০০৪]
তাঁর লেখা একটি জনপ্রিয় কিশোর উপন্যাস। আমেরিকান ফিল্ম ডিরেক্টর ও লেখক David Twohy পরিচালিত ফিকশনধর্মী হরর ফিল্ম Pitch Black [2000- Story by Jim Wheat & Ken Wheat] ও আমেরিকান লেখক Frank Laura রচিত Pitch Black: Fight Evil With Evil গ্রন্থের অনুকরণে লিখেছেন বলে পাঠকের অভিযোগ রয়েছে।
আমি তপু [২০০৫]
তাঁর লেখা একটি কিশোর উপন্যাস। উপন্যাসটি আমেরিকান জনপ্রিয় লেখক Dave Pelzer রচিত A Child Called It [1995] নামক গ্রন্থ থেকে কপি করেছেন বলে অনেক পাঠকের দাবি।
সহায়ক তথ্যসূত্রঃ
[উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, বিডিনিউজ২৪, এবিনিউজ২৪, বাংলা ট্রিবিউন, মুক্তমনা ব্লগ, সচলায়তন ডটকম, প্রজন্ম ব্লগ, সদালাপ ব্লগ, আমার ব্লগ এবং তাহাদের নকলনামা- আরিফ আজাদ]
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
[অতিথি কলামে প্রকাশিত মতামত একান্তই লেখকের নিজস্ব। লেখকের কোনো মতামতের দায়ভার অ্যানালাইসিস বিডি কর্তৃপক্ষ নিবে না]
Discussion about this post