অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
ঢাকার রাজনীতিতে একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। নানা কর্মকাণ্ডে তিনি আলোচিত সমালোচিত। রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে রাজপথে লুঙ্গি পরেই নেমে পড়তেন তিনি। তাই ‘লুঙ্গি মায়া’ হিসেবেও তিনি সমধিক পরিচিত। আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই তাকে ঘিরে রেখেছে বেশি সময়। নিজের দুর্নীতি-অপকর্ম, পুত্রদের অপকর্ম, মেয়ে জামাতার চাঞ্চল্যকর খুন, এরকম অসংখ্য কর্মকাণ্ডে জর্জরিত তিনি। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্যাগ ব্যবস্থপনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী হলেও নিজের পরিবারের দুর্যোগ সামাল দিতেই ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। বরং সেই দুর্যোগ অনেক ক্ষেত্রে তার প্রশ্রয়েই হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ১৯৯৬ শাসনামলে মায়া প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে বড় ছেলে দীপু চৌধুরীকে ঘিরে নানা কাহিনী তাকে বিব্রত করেছিল। এবারের শাসনামলে করছে ছোট ছেলে রনি চৌধুরী। গুলশান, বনানী ও উত্তরায় মন্ত্রীপুত্র রনি চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। এবার তিনি বিব্রত তার মেয়ের জামাতা সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মাদের ফাঁসির রায় বহালে। নারায়নগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলায় আপিল বিভাগেও তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে। মূলত ৭ খুনে নেতৃত্ব দিয়েছে মায়ার বেপরোয়া এই জামাতা।
জানা যায়, মায়াপুত্রদের কারণেই র্যাবে থাকার সময় তারেক সাঈদ বেপরোয়া ছিলেন। কারাগারে থাকাকালিন মায়ার দুই পুত্রের পরামর্শে হাসপাতাল থেকে পালানোরও পরিকল্পনা করেছিলেন তারেক সাঈদ। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ সবকিছু টের পেয়ে যাওয়ায় তারেক পালাতে পারেননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ডিভিশন পাওয়া এই হাজতি ঢাকা মেডিকেলের পুরনো ভবনের তৃতীয় তলায় ৪৩ নম্বর কেবিনে থাকতেন। হাসপাতালের কেবিনকে তারেক সাঈদ নিজের বাড়িঘরের মতো ব্যবহার করার কারণে নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। তারেক সাঈদের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা অবাধে যাতায়াত করতেন হাসপাতালে। এভাবেই একসময় পালানোরই চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সচেতনতায় পারেননি।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহৃত হন। এর দুদিনের মাথায় র্যাব-১১ এর সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মাহমুদ ও নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপারসহ কয়েক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পরদিন শীতলক্ষ্যা নদীতে অপহৃতদের লাশ ভেসে ওঠে। পরবর্তিতে প্রমাণিত হয় টাকার বিনিময়ে তারেক সাঈদের নেতৃত্বেই এই নির্মম হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। এর সাথে আরো কয়েকজন র্যাব কর্মকর্তাও জড়িত ছিলো। নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর সহিদ চেয়ারম্যানের ভাষ্যমতে কাউন্সিলর নুর হোসেনের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা নিয়ে র্যাব-১১ নজরুলকে হত্যা করেছে’। র্যাব-১১ এর অধিনায়ক ছিলেন তারেক সাঈদ।
মামলা চলাকালিন সময়ে মায়া অনেক চেষ্টা করেছিলেন জামাতাকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু ঘটনাটি এতটাই মর্মান্তিক ও মিডিয়ায় ব্যপক আলোচিত ছিল যে, প্রভাবশালী হওয়া সত্ত্বেও কিছুই করতে পারেননি মায়া। জামাতাকে চাকরিচ্যুত করার পর পরই মায়া এক বিবৃতিতে হুংকার দিয়ে বলেছিলেন- “আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে রাখতে চাই, এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত মামলায় অভিযুক্তদের সঙ্গে আমার পরিবারের কোনো সদস্যের কখনোই কোনো রকম যোগাযোগ বা ব্যবসায়িক লেনদেন বা সম্পর্ক ছিল না।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে মামলার তদন্তে প্রভাব সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।
আলোচিত এই সাত খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের নিয়মিত ও জেল আপিল এবং ডেথ রেফারেন্সের ওপর রায়ে নূর হোসেন, তারেক সাঈদ, আরিফ ও রানাসহ ১৫ জনের ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। মঙ্গলবার (২২ আগস্ট ২০১৭) দুপুরে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ রায় ঘোষণা করে।
এর আগে গত ২৬ জুলাই রায় ঘোষণার জন্য ১৩ আগস্ট দিন ধার্য করে আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। এরপর ১৩ আগস্ট আদালত রায় না দিয়ে তারিখ পিছিয়ে আজ (২২ আগস্ট) রায় ঘোষণার দিন ঠিক করেন। গত ১৬ জানুয়ারি সাত খুন মামলার রায় দেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন। মামলার প্রধান আসামি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র্যাবের বরখাস্তকৃত তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এ মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন আদালত।
Discussion about this post