অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
২০০৯ শুরুতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই র্যাব-পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠতে শুরু করে। প্রথমে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিরোধীদলের মিছিল-সমাবেশে প্রকাশ্যে গুলি করে নেতাকর্মীদের হত্যা করতে শুরু করে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে র্যাব-পুলিশের গুলিতে সারাদেশে দুই’শ মানুষের বেশি প্রাণ হারিয়েছে। ওই ঘটনাকে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছিল। এরপর একই বছরের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে রাতের আঁধারে আরেক গণহত্যা চালিয়েছিল র্যাব-পুলিশ।
এরপর দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন যখন গণআন্দোলনে রূপ নিতে শুরু করে তখনই সরকার বিরোধীদলের আন্দোলন দমাতে বেছে নেয় গুম-অপহরণের পথ। প্রথমেই গুম করা হয় ঢাকার সাবেক কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে। তারপর একই ভাগ্য বরণ করতে হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে। আজও পর্যন্ত তাদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
এভাবেই দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুম-অপহরণ ও খাল-বিল-নদী থেকে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের লাশ উদ্ধার শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বিএনপি, ছাত্রদল, জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের কয়েকশ নেতাকর্মীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপহরণ করে নিয়ে গুম করেছে। অনেকের লাশ ফেরত পাওয়া গেছে। আবার অনেকের লাশও পায়নি তাদের পরিবার। আর জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আযমী ও জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমানকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ পায়নি পরিবার।
বাংলাদেশের এসব গুম-অপহরণ ও গুপ্তহত্যা নিয়ে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো কিছুদিন পর পরই উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিচ্ছে। গুম-অপহরণের তথ্য-প্রমাণসহ প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে তারা। এমনকি র্যাবের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার জন্যও তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এসব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। বরং বিএনপি-জামায়াতের টাকা খেয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
সর্বশেষ গত বুধবার বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিরোধীদলের তথা বিএনপি-জামায়াতের শত শত নেতাকর্মীকে গোপন বাসা-বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গোপন স্থানে আটকে রাখার এক চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২০১৩ সাল থেকে শত শত মানুষকে অবৈধভাবে আটক করেছে এবং গোপন স্থানে আটকে রেখেছে। যাদের মধ্যে কয়েকজন বিরোধী নেতাও রয়েছেন। ৯০ জনের তথ্য রয়েছে, যাদের শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই গুম করা হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগকে এক সপ্তাহ বা একমাস গোপন স্থানে আটকে রাখার পর আদালতে হাজির করা হয়েছে। এরকম আটক ২১ জনকে পরে হত্যা করা হয়েছে আর নয় জনের কোন তথ্যই আর জানা যায়নি। এই ৯০ জনের তালিকায় মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া তিন বিরোধী নেতার তিন সন্তান রয়েছে, যাদের একজন ছয়মাস পরে ফিরে এসেছেন। বাকি দুইজনের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এছাড়া ২০১৭ সালের প্রথম পাঁচ মাসে এরকম ৪৮ জনের নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি আদনান চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যায় র্যাবের সদস্যরা। তার বাবা রুহুল আমিন চৌধুরী সংস্থাটিকে বলছেন, তাদের বলা হয়েছিল, পরদিন র্যাব সদস্যরা তাদের ছেড়ে দেবে। র্যাব বললো, আমরা তাকে নিয়ে যাচ্ছি, আমরাই আবার তাকে ফেরত দিয়ে যাবো। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে’।
এরপর নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের পরিবারের কাছে একজন জ্যেষ্ঠ র্যাব কর্মকর্তা গোপনে জানিয়েছেন, সুমনসহ আরো পাঁচজন তার হেফাজতে ছিল। কিন্তু তিনি তাদের হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর অন্য র্যাব কর্মকর্তারা তাদের নিয়ে যান। তার ধারণা, এই ছয়জনের কেউ বেঁচে নেই।
সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট কিছু নামও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু, এরপরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আজ বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রমাণ নেই।
ওবায়দুল কাদেরের এ মন্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সবখানেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, ওবায়দুল কাদের আর কী তথ্য চান? সচেতন মানুষও বলছেন, চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী, আমান আযমী, ব্যারিস্টার আরমানের গুমের ঘটনা কি ভুয়া? ওবায়দুল কাদের আর কী প্রমাণ চান?
এদিকে, রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যদি মনে করে থাকে যে তারা নিজেরাই লুকিয়েছেন। তাহলে সেটাও প্রমাণ করার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা অনেক যোগ্য ও দক্ষ। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশের ভেতর কোনো নাগরিকের লুকিয়ে থাকা সম্ভব হবে না। এসব গুম-অপহরণের সঙ্গে সরকার জড়িত। এজন্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ইচ্ছে থাকলেও সরকারের নির্দেশ তারা অমান্য করতে পারছে না।
Discussion about this post