অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
দেশের যত অনিয়ম, দুর্নীতি, লুন্ঠন থেকে শুরু করে ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, জমি দখল, ক্যাম্পাস দখল সর্বক্ষেত্রের নেপথ্যে বেরিয়ে আসে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর নাম। এছাড়া ক্ষমতায় আসার পর থেকে আওয়ামীলীগ নিজের দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে বিভিন্ন সেক্টর দখল করেই চলছে।
সম্প্রতি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার মুকুলের ফোনালাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সারাদেশে ব্যপক সমালোচনার তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। ফাঁস হওয়া ফোনালাপে শোনা যায়-কামরুন নাহার মুকুল খুব অশালীন ভাষা ব্যবহার করে এবং গালাগালি করে। তার বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল-তিনি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করে আসা মেয়ে। তিনি ভদ্র না। যুব মহিলা লীগের সভাপতিও ছিলেন। সেই সময় তিনি পিস্তল বালিশের নিচে রেখে ঘুমাতেন। এমনকি মহিলা লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে কোন ওই ব্যক্তিকে রাস্তায় ফেলে কাপড় খুলে পিটাবেন বলে ফোনালাপে বলে ওই নেত্রী ।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের বাক্যলাপ এমন কুরচিপুর্ণ কীভাবে হতে পারে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে জনমনে প্রশ্ন। এছাড়া এমন একজন বেপরোয়া ব্যক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান হয় কীভাবে তা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যায়। যদিও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা প্রথম প্রকাশ্যে আসলেও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাস গুলোতে এমন ঘটনা নিত্যদিনের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোকে অস্থিরতা সৃষ্টি করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের একটি মিশনে নেমেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গুলোতে শিক্ষক নিয়গে দলের নেতাকর্মীদের ঢুকানো হয়। এছাড়া ছাত্রলীগ দিয়ে প্রতিটি ক্যাম্পাসে অস্থিরতাও প্রকাশ্যেই চলছেই। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে ঘটনা প্রকাশ্যে এলো এমনভাবে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে আওয়ামী সিন্ডিকেট রয়েছে। যার মাধ্যমে ভর্তি বানিজ্য, নিয়োগ বানিজ্য থেকে শুরু করে সব কিছুই জিম্মি করে রেখেছে তারা। শুধু তাই নয় প্রথমিক বিদ্যালয় গুলোতেও কমোলমতি শিশুদের ওপরেও বিভিন্ন কমিটি দিয়ে মেধাশক্তি নষ্টে কাজ করছে। বর্তমান করোনাকালীন সময়ে যখন শোপিংমল থেকে শুরু করে সর্বস্থরের মানুষ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ তখনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এটাতো সবাই প্রকাশ্যেই দেখছেন।
দেখা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিয়ন্ত্রণের নেয়ার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনার আলোকে প্রথমেই দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদেরকে বাদ দিয়ে দলীয় নেতা করার্মীদর বসায় শেখ হাসিনা। প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দলীয় করণ করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। দলীয় রাজনীতিতে যে যত বড় মাস্তান, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও গুন্ডা ছিল, চাকরিতে তাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। ভিকারুন্নিসা স্কুলের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার মুকুলও সেই যোগ্যতা বলেই চেয়ারে বসেছে।
ভর্তিতে অনিয়ম ও বানিজ্য:
প্রায় এক দশক ধরে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আওয়ামী সিন্ডিকেটের কারনে কোনো অধ্যক্ষ বেশি দিন দায়িত্ব পালন কিংবা মেয়াদ শেষ করতে পারেন না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা অধ্যাপক ফৌজিয়াকে প্রেষণে নিয়োগ করেন। প্রথমে তাকে উল্লিখিত সিন্ডিকেট মেনে নেয়নি। পরে তিনি অবৈধ ভর্তি ও নিয়োগে সিন্ডিকেটের কাছে আত্মসমর্পণ করলে মেনে নেয়। কিন্তু পরে তাকে প্রত্যাহার করা হয়।
জানা গেছে, এরপর বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক কামরুন নাহারকে পদায়ন করে সরকার। শুরু থেকে অবৈধ ভর্তি নিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যদের সাথে নিজেও জড়িত ছিলেন। পরে টাকা ভাগাভাগিসহ বিভিন্ন কারনে তাদের মধ্যে ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। এসব নিয়ে অফিসে দুদফায় তালা লাগিয়ে দেওয়া, বাড়ির দরজায় ধাক্কাধাক্কির মতো ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া কথিত অভিভাবক ফোরামের এক সদস্য ৩০ মার্চ অবৈধ ভর্তি করে। পরে টাকার ভাগ চাইলে ওই সদস্য তাকে টাকার ভাগ দেবে না বলে জানিয়ে দেয়।
দুর্নীতি অনিয়মের ছড়াছড়ি:
জানা গেছে, স্কুলের বিভিন্ন ধরনের সংস্কার ও মেরামতের লক্ষ্যে সম্প্রতি দুই কোটি টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেয় পরিচালনা কমিটি। ওই কাজের মান নিয়ে আপত্তি ওঠে। এরপর একটি অভ্যন্তরীণ কমিটি এটি তদন্ত করে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরও এটি তদন্ত করছে। ওই কাজের সঙ্গেও পরিচালনা কমিটিতে থাকা কোনো কোনো অভিভাবক সদস্য জড়িত আছেন। এ কাজের জন্য ইতোমধ্যে এক কোটি ৫৯ লাখ টাকা স্কুল তহবিল থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। কাজের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা বাকি টাকা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছিলেন অধ্যক্ষকে। কিন্তু তাদের বিষয়টি তদন্তাধীন থাকায় অধ্যক্ষ বিল পরিশোধ করেননি। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা অধ্যক্ষের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। সব মিলে এক দিকে অধ্যক্ষ আরেক দিকে কিছু অভিভাবক এবং শিক্ষক অবস্থান নিয়েছেন।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ সুজন সোমবার দাবি করেন, স্কুলের ৭১ বছর বয়সে ক্যাম্পাসে কোনো দিন গরুর হাট বসেনি। অধ্যক্ষ তা বসিয়েছেন। তিনি অভিভাবকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ঠিকমতো অফিস করেন না। অভিভাবকরা তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখেন। এসব কারণে আমরা তার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে অপসারণ দাবি করেছি। আর তিনি যে অভিভাবকদের গালাগাল করেন তার প্রমাণ মীর শাহাবুদ্দিন টিপুর ঘটনা।
মীর সাহাবুদ্দিন টিপুর সঙ্গে অধ্যক্ষের কথোপকথন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টিপু ভাই গত শুক্রবার শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের বিষয়ে তাকে ফোন করেন। এ সময় তিনি অভিভাবক প্রতিনিধি ও সাধারণ অভিভাবকদের গালাগাল করেন।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাধিক শিক্ষক জানান, প্রতিষ্ঠানটি ঘিরে যেসব অবৈধ কার্যক্রম চলছিল তার সাথে অধ্যক্ষ পরক্ষ ভাবে জড়িত ছিলো। সম্প্রতি টাকা ভাগাভাগিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটি এবং অভিভাবক ফোরামের চিহ্নিত ব্যক্তিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
শুধু ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ নয় দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আওয়ামী কমিটি, প্রতিষ্ঠান প্রধান, অভিভাবক ফোরামের নামে সিন্ডিকেট গড়ে তুলছে। যার বলি হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ব্যহত হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষকরাও মেতে উঠেছে টাকার রাজনীতির খেলায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও আওয়ামী পিস্তলধারীদের দখলে
মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর এমন ঘটনা প্রথম প্রকাশ্যে আসলেও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রকাশ্যে চলে ভর্তি বাণিজ্য কিংবা অনিয়ম দুর্নীতির ছড়াছড়ি। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর প্রধান চেয়ার দখল করে ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম দুর্নীতি ভর্তি বাণিজ্যের সাথে যুক্ত থাকাসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে চলে আসায় ভিসি পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সাবেক যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানকে। এছাড়া জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়েরে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম আওয়ামী লীগের একানিষ্ট কর্মী ছিলেন। ছাত্রলীগের সাথে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বিতর্কে আসলেও শেখ পারিবারের সাথে সম্পর্ক থাকার কারনে এখনও স্বপদে বহাল রয়েছে। তারপর থেকে থামছেনা বিশ্ব বিদ্যালয়টির অনিয়ম দুর্নীতি।
এছাড়া গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক খোন্দকার নাসিরউদ্দিনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান চেয়ার ক্ষমতাসীনদের দখলে রয়েছে। যার ফলে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসস্তুপে পরিনত হচ্ছে।
অন্যদিকে ক্যাম্পাস গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ক্যাম্পাস গুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টি করে চলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ মুলত দেশকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে। সর্বক্ষেত্রে তাদের দখলে নিয়ে লুটে খেতে চাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের পাট শিল্প, ট্যানারি শিল্প ধ্বংস করেছে। ব্যাংক গুলো লুট করে থেকে ঋণখেলাপী করছে। করোনার অযুহাত দিয়ে গার্মেন্টস সেক্টর ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দখল করেছে প্রশাসন থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোও যার ফলে জাতি মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে না পারে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে দেশের তরুণ সমাজের মেধা নষ্ট করার নতুন মিশনে তারা নেমেছে।
Discussion about this post