সম্প্রতি কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল–জাজিরায় প্রচারিত অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন তথ্যচিত্রে এই দুই ভাইকে পলাতক আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হলে সরকারের পক্ষ থেকে সেটা অস্বীকার করা হয়। কিন্তু প্রথম আলো ও নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে সরকারের মিথ্যাচার প্রমাণ হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বহুল আলোচিত দুই সহোদর হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের সাজা মওকুফ করেছে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা। হারিছ দুটি এবং আনিস একটি খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ তাঁদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে গেলেও এত দিন তা গোপন ছিল।
সাজা মওকুফের এই ঘটনা প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দশটি দিক পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:
১. সাজা মওকুফ ঘটেছে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে
সরকার এবং সেনাপ্রধানের পরিবার এই আদেশ গোপনীয় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। আইন মেনেই বিষয়টি সম্পন্ন হয়েছে বলা হলেও তারা বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশের বহু সুযোগ পেয়েও তা করেন নি। অভিযুক্তদের জবাব দেবার অধিকার রক্ষার্থে আল জাজিরা সংশ্লিষ্ট সকলকে তথ্যচিত্র সম্প্রচারের আগেই অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছিল। কিন্তু তারা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন নি। এর পর আরো সপ্তাহ খানেক পার হয়েছে, তখনো তারা নিশ্চুপ থেকেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী সম্প্রতি ডয়েচে ভেলেতে সাক্ষাৎকার দেবার সময়ও সাজা মওকুফ বিষয়ে কিছু বলেন নি। হয় তিনি জানতেন না, বা প্রকাশ করতে চান নি। এদিকে, আইন মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী দুজনই প্রথম আলোকে বলেছেন তারা এই আদেশের বিষয়ে কিছু জানতেন না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়েবসাইটে হারিসকে পলাতক আসামি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। সাজা মওকুফের আদেশ বিষয়ে তাহলে পুলিশও কিছু জানেনা বলেই প্রতীয়মান হয়।
২. হারিস, আনিসকে সবাই পলাতক জানুক তাই চেয়েছিল সরকার
সাজা মওকুফ নিয়ে অসামান্য গোপনীয়তা এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের এই আদেশের কথা চেপে যাওয়া থেকে অনুমেয় যে, সরকার আসলে চেয়েছিল এই দুইজনের সাজা গোপনে মাফ করে দেয়ার বিষয়টি কেউ না জানুক। বরং পলাতক হিসেবেই এদেরকে দেখানো বেশি সুবিধাজনক।
আরো অনুমেয় যে, পলাতক থাকা সত্ত্বেও এই দুইজনকে সরকারের পক্ষ থেকে এধরনের বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে কারণ তারা সেনাপ্রধানের ভাই। এতে করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রস্থলে কি ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটে এবং স্বজনপ্রীতি চর্চা হয় তা নিয়ে গুরুতর অনেক প্রশ্ন চলে আসে।
৩. হারিস ও আনিস বেকসুর খালাস নন
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) তাদের সর্বশেষ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলছে হারিস ও আনিস “অব্যাহতি” পেয়েছেন: “গত ২৯ মার্চ ২০১৯ তারিখে সেনাবাহিনী প্রধানের ছেলের বিবাহোত্তর সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান হয় যেখানে বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। অথচ তার পূর্বেই সেনাবাহিনী প্রধান এর ভাইগণ (আনিস এবং হাসান) তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে ষড়যন্ত্রমূলক, পরিকল্পিতভাবে দায়েরকৃত সাজানো ও বানোয়াট মামলা হতে যথাযথ আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই অব্যাহতি পান। ফলে ২৯ মার্চ ২০১৯ তারিখে সেনাবাহিনী প্রধানের ছেলের বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানে তার কোন ভাই কোন দন্ডপ্রাপ্ত বা পলাতক আসামি অবস্থায় ছিলেন না, বরং সম্পূর্ন অব্যাহতিপ্রাপ্ত হিসেবেই তারা ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন এবং উক্ত সময়ে তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় বা চলমানও ছিল না।”
তারা “অব্যাহতিপ্রাপ্ত” একথা সঠিক না। তাদের কখনোই অব্যাহতি প্রদান করা হয়নি এবং তারা এখনো দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিই আছেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির হবার সময়ও তারা দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা সরকারকে কেবল দণ্ড মওকুফ বা মাফ করে দেবার ক্ষমতা প্রদান করে। এই সিদ্ধান্তের সাথে তাদের দোষী সাব্যস্ত হবার কোন সম্পর্ক নেই। আদালতের রায়ে তারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, এবং তা পরিবর্তিত হয়নি।
৪. সরকারি আদেশে সাজা মওকুফ অত্যন্ত বিরল
নেত্র নিউজ বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজ্ঞের সাথে কথা বলেছে। তাদের কেউই ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা বলে কারো সাজা মওকুফের নজির জানেন না, পলাতক আসামির ক্ষেত্রেতো নয়ই। এই ক্ষমতা আগে ব্যবহৃত হবার নজির থাকলেও তা অত্যন্ত বিরল।
৫. আদেশের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন
সরকারের এই আদেশ আদৌ বৈধ কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে, কেননা যাদের সাজা মওকুফ হয়েছে তারা ছিলেন পলাতক। আইনজীবী শাহদীন মালিকের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রথম আলো লিখেছে যে তার মতে এই আদেশ বেআইনি হবে কেননা ৪০১ ধারার ক্ষমতা প্রয়োগ করে কারো সাজা মওকুফ করতে হলে সে ব্যক্তি পলাতক হওয়া যাবেনা। শাহদীন মালিক ডয়েচে ভেলের সাথে দেয়া সাক্ষাতকারে তার বক্তব্যের সমর্থনে আরো জোরালো আইনি যুক্তি উপস্থাপন করেন। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একই মত পোষণ করেন বলেই মনে হয়েছে প্রথম আলোতে তার মন্তব্যে: “কোনো আইনগত অধিকার পলাতক আসামি পায় না। আইনগত অধিকার পেতে হলে তাকে সারেন্ডার (আত্মসমর্পণ) করতে হয়।”
৪০১ ধারাতে অবশ্য স্পষ্টভাবে পলাতক আসামির ক্ষেত্রে কি ঘটবে তার উল্লেখ বা সেক্ষেত্রে নিষেধ নেই। কাজেই এর সঠিক প্রয়োগ নির্ধারিত হবে আদালতের বিবেচনায়। আইনি নজির ও অন্যান্য সুবিচারের বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তার ভিত্তিতে আদালতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ৪০১ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা পলাতকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কিনা। যদি আদেশ কে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে বিষয়টি উত্থাপন করা হয় সেক্ষেত্রে আমরা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট সমাধান পাব।
৬. সাজা মাফের যে কারণ আদেশে বলা হয়েছে
যে গোপন আদেশের মাধ্যমে সাজা মাফ করে দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়: “রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ষড়যন্ত্রমূলক, পরিকল্পিত, সাজানো ও বানোয়াট মামলায়, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত নিম্নবর্ণিত ০২ (দুই) জন আসামিকে… যাবজ্জীবন সাজা ও অর্থ দন্ড ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার কর্তৃক মওকুফ করা হয়েছে”। বাংলাদেশে এমন মামলা অহরহ ঘটে, তা সত্য। কিন্তু সেই যুক্তি আদালতে উপস্থাপন করে প্রমাণ করাটা হলো যথাযথ প্রক্রিয়া। এখানে উল্লেখ্য যে, তোফায়েল আহমেদ জোসেফ (খুনের মামলায় দণ্ডিত আরেক ভাই) এই দাবী আদালতে পেশ করেছিলেন। বিচারিক আদালত থেকে হাই কোর্ট এবং আপিল বিভাগ সব আদালতে তা অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। আনিস আহমেদও একই দাবী করেছিলেন বিচারিক আদালত ও হাই কোর্টে। হাই কোর্টে সাজা বহাল থাকার পর এবং আপিল বিভাগে মামলা যাবার আগেই তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন বিধায় সেখানে এই যুক্তি তিনি উপস্থাপন করেন নি। আর হারিস আহমেদ কখনো আদালতেই হাজির হননি — নিজের পক্ষে এই যুক্তিও পেশ করেন নি।
৭. একটি নয়, দুটি যাবজ্জীবন সাজা মাফ করা হয়েছে হারিসের
আল জাজিরার তথ্যচিত্রে ১৯৯৬ সালের মে মাসে ঘটিত মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফার হত্যাকাণ্ড এবং তাতে হারিস ও আনিসের যাবজ্জীবন সাজা পাবার বিষয়ে দেখানো হয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে সাজা মওকুফের যে আদেশ প্রকাশিত হয়েছে সে আদেশবলে কেবল মোস্তফা খুনের সাজা মাফ করা হয়নি, সাথে হারিসের আরো একটি যাবজ্জীবন সাজা মওকুফ করা হয়েছে। সেই যাবজ্জীবন দণ্ড তিনি পেয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে আবু মোরশেদ নামক ছাত্রদলের একজন কর্মীকে খুনের দায়ে।
দ্বিতীয় এই মামলায় হারিসের ভাই জোসেফও আসামি ছিলেন ও দণ্ডিত হয়েছিলেন। মোস্তফা হত্যা মামলার মতো এখানেও হারিসকে যাবজ্জীবন এবং জোসেফকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়েছিলেন আদালত। মোস্তফা হত্যায় জোসেফের সাজা লাঘব করে যাবজ্জীবন করা হয় ২০১৫ সালে, এবং তিনি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে মুক্তি লাভ করেন ২০১৮ সালে। জোসেফ দ্বিতীয় মামলার সাজা থেকে কীভাবে মুক্ত হলেন তা প্রথম আলোর প্রতিবেদনে জানা যায়নি।
৮. আল জাজিরার উত্থাপিত অভিযোগ অপ্রমাণ হয়নি
সাজা মওকুফের আদেশ দেয়া হয় ২০১৯ সালের মার্চে। অর্থাৎ, এর আগ পর্যন্ত হারিস ও আনিস আনুষ্ঠানিকভাবে পলাতক ছিলেন। জেনারেল আজিজ তার পলাতক ভাইকে মিথ্যা পরিচয় তৈরি করে (মিথ্যা জন্মসনদ, নিকাহনামা, পাসপোর্ট এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট) ইউরোপে আত্মগোপনে সাহায্য করেছিলেন ২০১৪ সালে, সাজা মওকুফের পাঁচ বছর আগে। সেখানে তাকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতেও সাহায্য করেছেন সে সময়। হুইসেলব্লোয়ার সামির সাথে আজিজের সকল যোগাযোগ ঘটেছে ২০১৯ সালের আগে। তিনি হাঙ্গেরি গিয়ে তার ভাইয়ের সাথে দেখাও করেছেন ২০১৯ এর আগে। এসব কিছু বাদ দিলেও হারিস কীভাবে সরকারি ঠিকাদারি জোগাড় করেন, কিভাবে নিজের সম্পদ গড়ে তুলেছেন, কিভাবে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ানকে নিজের অবৈধ কাজে খাটান — এর সবই হতবাক হবার মতো তথ্য এবং অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। সেসময় তিনি পলাতক ছিলেন কি ছিলেন না তাতে এর গুরুত্ব কিছুমাত্রায় কমে যায় না।
৯. হারিসের মিথ্যা পরিচয়ের অস্তিত্ব স্বীকার করেছে আইএসপিআর
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) আল জাজিরার তথ্যচিত্র সম্পর্কিত তাদের সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। দুই ভাইয়ের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তারা হারিস আহমেদকে “হাসান” হিসেবে অভিহিত করেছে। হাসান হলো হারিসের বানানো নাম যেটা ব্যবহার করে তিনি পাসপোর্ট বানিয়েছেন। সেই মিথ্যা নামের পাসপোর্ট দিয়ে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন এবং একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার মিথ্যা নাম প্রতিষ্ঠা করতে অসত্য জন্মসনদ, শিক্ষা সনদ ও নিকাহনামা তৈরি করা হয়েছে, যেগুলো ব্যবহার করে তিনি হারিস থেকে হাসান হয়েছেন। এই মিথ্যা নামের অধীনে, মিথ্যা সনদগুলো ব্যাবহার করে তিনি একটি জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলেছেন।
“হাসান” নাম ব্যাবহারের মাধ্যমে আইএসপিআর হারিসের মিথ্যা পরিচয়ের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে বলা যেতে পারে। প্রশ্ন আসে এখনো কি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তদন্ত করবে না? একই সাথে তোফায়েল আহমেদ জোসেফের মিথ্যা পরিচয় তৈরি করার বিষয়টিও তদন্তের দাবী রাখে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে নেত্র নিউজ জোসেফের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল যে তিনি তানভীর আহমেদ তানজিল এই ভুয়া নাম দিয়ে একটি পাসপোর্ট বানিয়েছেন।
১০. যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে
আহমেদ ভাইদের এই কাহিনী মূলত বিচারহীনতারই গল্প, যেখানে কিনা দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির তিন ভাই তাদের খুনের অপরাধের সাজা থেকে মওকুফ কিংবা ক্ষমা লাভ করেছে। অথচ, খুনের দায়ে দণ্ড পাওয়ার পরও তিন ভাইয়ের মধ্যে দুই জনকে একটি দিনও কারাগারে কাটাতে হয়নি