আহমেদ আফগানী
শেখ হাসিনা এক যুগ ধরে ক্ষমতায়। তার অপ্রাপ্তির কিছু নেই। তিনি চাইলে যে কাউকে গায়েব করে দিতে পারেন। এমন সময়ে তিনি কেন বহুদিন ধরে সন্ত্রাসী হারিস ও জোসেফের কলঙ্ক নিয়ে আছেন? কেন তাদের সাথে নিয়ে ঘুরছেন? কেন এই পরিবারের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করছেন না? আমরা এই প্রসঙ্গে আসবো তবে তার আগে অন্য একটি প্রসঙ্গে দৃষ্টিপাত করি।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর শেখ মুজিবের হত্যাকারী সেনা অফিসাররা বিশেষ বিমানযোগে দেশ ত্যাগ করেন। তারা প্রথমে ব্যাংকক যান। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশ ঘুরে লিবিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত লিবিয়াকেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তারা। এরমধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন দেশের মিশনেও কাজ পেয়েছিলেন।
লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ ও কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান লিবিয়ায় রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা পেতেন। খন্দকার আবদুর রশিদ ত্রিপোলিতে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি গড়ে তোলেন। সেই কোম্পানি গড়ে তোলার জন্য গাদ্দাফি তাকে অর্থ দিয়েছিলেন। আর সৈয়দ ফারুক রহমান লিবিয়ায় জনশক্তি রফতানি কোম্পানি খুলেছিলেন। সেই কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিতো লিবিয়ায়।
লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির পৃষ্ঠপোষকতায় আবদুর রশিদ ও ফারুক রহমান ঢাকার হোটেল শেরাটনে ১৯৮৭ সালের ৩ আগস্ট গড়ে তোলেন একটি রাজনৈতিক দল। নাম দেন ফ্রিডম পার্টি। এর বর্তমান চেয়ারম্যান হলেন কর্নেল ফারুকের পুত্র সৈয়দ তারিক রহমান। তিনি এখন অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন।
এদিকে তৎকালীন ঢাকার মোহাম্মদপুরে দুই ভাই মিজানুর রহমান মিজান ও মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা নব্য গুণ্ডা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা ছিনতাইকারী থেকে তাদের গুণ্ডামির ক্যারিয়ার শুরু করে। ফ্রিডম পার্টি যুগের চাহিদা অনুসারে স্বাভাবিক রাজনীতির পাশাপাশি অস্ত্রের রাজনীতিতেও ভূমিকা রাখতে চায়। তারা টার্গেট করে এই দুই ভাইকে। মিজান ও মোস্তফা ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দেন। ফারুক-রশিদরা তাদের গুণ্ডাদের ভালো প্রশিক্ষণ দিতে নিয়ে যায় লিবিয়াতে। যাদের তারা লিবিয়া থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনে তাদের মধ্যে মিজান ও মোস্তফাও ছিল।
শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসেন। ফিরে এসেই তিনি তার বাবার মুজিবের মতো গুণ্ডাবাহিনীগুলো সক্রিয় করতে থাকেন। বর্তমান সেনাপ্রধানের ভাই আনিস আহমেদ ও হারিস আহমেদও হাসিনার গুণ্ডাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হন। জেনারেল আজিজ আহমেদই সেনাবাহিনীতে চাকুরি পান। আনিস ও হারিস গুন্ডামীতে দক্ষ হওয়ায় তারা শেখ হাসিনার বডিগার্ডের দায়িত্ব পান। হারিস তৎকালীন ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও হয়েছিলেন তিনি।
জোসেফ তার বড় ভাইয়ের ক্যাডার বাহিনীর প্রধানের দায়িত্বপালন করেন। এরপর থেকে মোহাম্মদপুর-হাজারীবাগসহ আশপাশের এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন জোসেফ। যোগ দেন সুব্রত বাইনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আলোচিত সেভেন স্টার গ্রুপে। পুরো রাজধানী তখন সেভেন স্টার গ্রুপ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ নামে দুটি বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করত। এভাবেই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় নাম উঠে আসে জোসেফের। টিপু কমার্শিয়াল কলেজের ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। তিনিও ভাইদের সাথে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে। এটা মাথাব্যাথার কারণ হয় ফ্রিডম পার্টির। কারণ তারা জানে হাসিনা সুযোগ পেলেই তার পিতার হত্যাকারীদের বিচার করবে। তাই তারা হাসিনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করে।
১৯৮৯ এর ১১ আগস্ট ফ্রিডম পার্টি শেখ হাসিনার বাসায় হামলা করে। এই হামলা হয় ধানমন্ডির ৩২ নং-এ শেখ মুজিবের বাসায়। রাত ১২টার দিকে ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসীর গুলি চালায় ও একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তবে সে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয় নি। সেসময় শেখ হাসিনার বডি গার্ডরা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে সন্ত্রাসীদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই হামলার সময় ফ্রিডম পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফাকে দেখে চিনতে পারে হারিস আহমেদ।
হারিসদের পরিবার অর্থাৎ সেনাপ্রধানদের পরিবারও থাকতেন মোহাম্মদপুরে। মোস্তফা ও তারা প্রতিবেশি ছিলেন। শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টা নিয়ে মামলা হয়। মামলায় মিজান ও মোস্তফা দুই ভাইকেই আসামী করা হয়। মামলা মামলার গতিতে চলতে থাকে। যেহেতু এই ঘটনায় কেউ মারা যায়নি তাই এর প্রতিক্রিয়াও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
এদিকে ১৯৯১ সালে এরশাদের পতন হয়। ফ্রিডম পার্টিও হারিয়ে যায়। মিজান ও মোস্তফা দুই ভাই মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরি মায়ার নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীতে যোগ দেয়। মানে তারা আওয়ামী লীগেই যোগ দেয়। মায়া চৌধুরী ঢাকার নেতা। সেই হিসেবে মিজান ও মোস্তফা মোহাম্মদপুরে তাদের প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে মিজান ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের নেতা হয়। এসময়ে সে হাসিনার মামলা থেকে বাঁচার জন্য নাম চেইঞ্জ করে হাবিবুর রহমান মিজান নামে নিজেকে পরিচিত করে। আর হাসিনা মোহাম্মদপুরের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে তাদেরকে দল থেকে বাদও দেয় না। তবে হাসিনা প্রতিশোধ পরায়ন। তাই তিনি চেয়েছেন মোস্তফাকে (যে ১৯৮৯ সালে সরাসরি আক্রমণে অংশ নিয়েছিল) গোপনে হত্যা করতে।
এজন্য শেখ হাসিনা দায়িত্ব দিয়েছেন তার বডিগার্ড হারিস আহমেদকে। হারিস তার ভাই জোসেফ ও আরো কিছু গুণ্ডা সাথে নিয়ে ১৯৯৫ সালে মোস্তফাকে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ মোস্তফা সাথে সাথেই মারা যায় নি। সাথে সাথে মারা গেলে হয়তো এই বিষয়টা নিয়ে এতো বেকায়দায় পড়তে হতো না। অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের মতোই পার পেয়ে যেত। হাসপাতালে মৃত্যু শয্যায় থেকে মোস্তফা তার হত্যাকারীদের নাম উল্লেখ করে দুইদিন পর মারা যায়। জোসেফকে পুলিশ এরেস্ট করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পালিয়ে যায় হারিস ও অন্যান্যরা।
এই ঘটনার কিছুদিন পর ১৯৯৬ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। এরপর তিনি তার ওপর হামলার প্রেক্ষিতে করা মামলা আবারো তদন্ত করান। সেখানে ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট হয়। এর মধ্যে নিহত মোস্তফার বড় ভাই মিজানও ছিল। একইসাথে মিজান তখন আওয়ামী লীগের নেতা। এই মামলা সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না। ১৯৯৯ সালে জেনারেল আজিজের ছোটভাই, ছাত্রলীগ নেতা ও কমার্শিয়াল কলেজের ভিপি টিপু অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়। ধারণা করা হয় নিহত মোস্তফার ভাই মিজান এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
এদিকে মোস্তফা ও টিপু হত্যা করা নিয়ে সেনাপ্রধানের পরিবারের সাথে মিজানের পরিবারের শত্রুতা তৈরি হয়। হারিস দেশে ফিরতে পারে না আর জোসেফ জেল থেকে ছাড়া পায় না। ২০০১ সালে আবারো বিএনপি ক্ষমতায় আসে। এই সময়ে মিজান তার ভাই হত্যার মামলা নিয়ে আগাতে থাকে যা এতোদিন হাসিনার কারণে আগানো সম্ভব হয়নি। অবশেষে জোট আমলে মোস্তফা হত্যা মামলায় ২০০৪ সালে হারিসকে যাবজ্জীবন ও জোসেফকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ঢাকার জজ আদালত।
ধীরে ধীরে মিজান মোহাম্মদপুরে আরো শক্তিশালী আওয়ামী নেতায় পরিণত হয়। মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পায়। কোণঠাসা হয়ে পড়ে জেনারেল আজিজের পরিবার। ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর আবারো শেখ হাসিনা সামনে নিয়ে আসে আজিজের পরিবারকে। এবার হারিসের নেতৃত্বে নয়, আজিজের নেতৃত্বে। ধীরে ধীরে জেনারেল আজিজ গ্যাং-এর উত্থান হতে থাকে। হারিস বিদেশে বড় ডনে পরিণত হয় যা আল জাজিরার রিপোর্টে প্রকাশিত হয়। জোসেফ ২০১৮ সালে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায়। হারিস ও জোসেফ নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশে এখন আসা যাওয়া করতে পারছে জেনারেল আজিজের ক্ষমতাবলে।
হাসিনার প্রশ্রয়ে সরকারিভাবে আজিজ পরিবার প্রতিষ্ঠিত হয়েই তারা এতোদিনের কোণঠাসা অবস্থার প্রতিশোধ নিতে চায় মিজান থেকে। মিজান মোহাম্মদপুরের আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। একইসাথে ৩২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। অন্যান্য আওয়ামী কাউন্সিলরদের মতোই ক্যাসিনো, ভূমি দখল, মাদক, খুন, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি ইত্যাদি সবধরণের অপরাধের সাথে জড়িত থাকে মিজান। এটাকে পুঁজি করে হারিস। হারিসের পরিকল্পনা ও নির্দেশে র্যাবের মেজিস্ট্রেট সরোয়ার মিজানের বাসায় অভিযান চালায় ও তাকে গ্রেপ্তার করে। যেটা আমরা আল জাজিরার ডকুমেন্টারি থেকে জেনেছি। এদিকে আমরা না বুঝে হুকুম তালিমকারী সরোয়ারকে সাহসী হিসেবে প্রশংসা করেছি।
২০১৯ সাল থেকে মিজান পরিবার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। মিজানের স্থলে কাউন্সিলর হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পায় ও নির্বাচিত হয় জেনারেল আজিজের ভাতিজা আসিফ আহমেদ। সে জেনারেল আজিজের বড় ভাই আনিস আহমেদের ছেলে। এভাবে মিজানের মাফিয়া চক্রকে উৎখাত করেছে আজিজ মাফিয়া চক্র। দুই মাফিয়া চক্রের শেল্টার আওয়ামীলীগ তথা শেখ হাসিনা।
এই পুরো ঘটনায় স্পষ্ট যে, হারিস ও জোসেফ যে অবর্ণনীয় ভোগান্তি সহ্য করেছিল তা শুধুমাত্র শেখ হাসিনার জন্য। আজিজ ও মিজান পরিবারের সাথে ব্যক্তিগত কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। হাসিনার প্রতিশোধ নিতে গিয়েই দুই পরিবারই তাদের একজন করে সদস্য হারিয়েছে ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। সেজন্য শেখ হাসিনা হারিস ও জোসেফের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তাদের নিয়ে সে চলতে চায়, তারা যতই তাকে বিড়ম্বনায় ফেলুক।