অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
অবশেষে বিদেশের মাটিতেই জীবনের শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করতে হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার জীবনের শেষ ইচ্ছে ছিল মৃত্যুটা যেন দেশের মাটিতে হয়। কিন্তু সেই ইচ্ছেটা পূরণের সুযোগ দিল না মুক্তিযুদ্ধের কথিত ধারক বাহক ও চেতনাধারী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে শুধু সাদেক হোসেন খোকাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার ওপর আঘাত করেছেন শেখ হাসিনা।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক অপারেশন পরিচালনা করেন সাদেক হোসেন খোকা। আর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মেয়র থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকার বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করেছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধারা কে কোন দল করে তা কখনও দেখেননি খোকা। তার কাছে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ই ছিল সবচেয়ে বড়।
সারাদেশের মানুষের আজ একটিই প্রশ্ন-এমন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে শেখ হাসিনা এমন আচরণ করলেন কেন? রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকতেই পারে, তাই বলে মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেশে আসতে দেবেন না! প্রায় এক সপ্তাহ ধরেই সামাজিক যোগ মাধ্যমসহ সর্বত্রই এনিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। মানুষ শুধু ক্ষোভ প্রকাশই করছে না, শেখ হাসিনাকে এজন্য ধিক্কারও দিচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
খোকার সঙ্গে শেখ হাসিনা কেন এমন আচরণ করলেন খোঁজ নিয়ে এর একাধিক কারণ জানা গেছে। তবে, মূল কারণ হলো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে রাজাকার না বলা।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বায়ুবীয় অভিযোগে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় শেখ হাসিনার গৃহপালিত বিচারপতি দ্বারা গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই রায়ের পরই আওয়ামীপন্থী মিডিয়া এটিএন নিউজের একটি টকশোতে সাঈদীকে নিয়ে সেদিন কিছু তিক্ত সত্য কথা বলেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা। ভারতের এজেন্ট মুন্নী সাহার তখন শুনা ছাড়া জবাব দেয়ার মতো কোনো সুযোগ ছিল না।
ওই টকশোতে খোকা বলেছিলেন-বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর জলিলের অধীনে কমান্ডার ছিলেন শাহজাহান ওমর। শাহজাহান ওমর বলেছেন-যুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির কোনো এই এলাকায় থাকার সুযোগ পায়নি। আর সাঈদী নামে কোনো রাজাকারের নামও তখন আমরা বরিশালে শুনিনি। এছাড়া, আওয়ামীপন্থী মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিনও বলেছেন-সাঈদী নামে কোনো রাজাকারের নাম আমরা শুনিনি। সুতরাং, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রাজাকার ছিলেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাদেক হোসেন খোকার সাঈদীকে নিয়ে দেয়া ওই বক্তব্যের পরই তার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন মুক্তিযুদ্ধের কথিত চেতনাধারী শেখ হাসিনা। কারণ, সাঈদীকে রাজাকার বানানোর জন্য আনা সব সাক্ষীই ছিল ভুয়া। তারপর স্কাইপি কেলেঙ্কারিতে ফাঁস হয়ে যায় সব তথ্য।। বিপরীতে খোকা ছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী। এসব কারণে খোকার ওপর সরকারের পক্ষ থেকে প্রচন্ড চাপ ছিল।
এরপর, চিকিৎসার জন্য খোকা আমেরিকা যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিতে থাকেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার টার্গেট ছিল খোকা যাতে আর দেশে ফিরতে না পারে।
এছাড়া আরেকটি কারণও জানা গেছে, সেটা হলো- ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসন (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) থেকে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় আসেন সাদেক হোসেন খোকা। খোকার কাছে পরাজিত হওয়ার কারণেও তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন শেখ হাসিনা।
এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র খোকা নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী হন। পরে তাকে ঢাকার মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া হয়। তিনি বিপুল ভোটে অবিভক্ত ঢাকার মেয়র নির্বাচিত হন। ২৯ নভেম্বর ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা মহানগরের মেয়র ছিলেন তিনি।
রাজনীতিবিদ খোকা প্রথমে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল কঠোর আন্দোলন শুরু করলে ঢাকায় বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় খোকাকে ১৯৯৬ সালে মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই সময় পুরান ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় তৈরির পাশাপাশি প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে দলকে শক্তিশালী করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল খোকার।
২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। পাশাপাশি খোকাকে সভাপতি ও আবদুস সালামকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। বিএনপির সবশেষ কমিটিতে খোকাকে ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়।