অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
অবশেষে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যুবক রায়হান আহমদ হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত পলাতক উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে (বরখাস্ত) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে, সিলেটের পুলিশ বাহিনী তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। সীমান্তবর্তী গ্রামের খাসিয়াদের হাতে ধরা পড়ে খুনি আকবর।
কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো-এসআই আকবরকে গ্রেফতারের ক্রেডিট নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সিলেট জেলা পুলিশ। সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন নির্লজ্জভাবে দাবি করছেন যে জেলা পুলিশই আকবরকে গ্রেফতার করেছে।
তার দাবি-আকবর সীমান্ত এলাকা দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে, এরকম তথ্য পুলিশের কাছে ছিল। তথ্যটি আমরা রবিবার (৮ নভেম্বর) পাওয়ার পরপরই অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করেছিলাম। সেইসঙ্গে অভিযানকারী দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সিলেটের কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ থানার ওসিকে। যেহেতু ওই দু’টি থানা সীমান্ত এলাকায়। পুলিশের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাধ্যমে আকবরকে কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।’
বিপরীত দিকে জানা গেছে, খাসিয়ারা প্রথমে আকবরকে আটক করে। তাকে আটকের কয়েকটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরালও হয়েছে। কারা, কীভাবে কোন অবস্থায় আকবরকে ধরেছে, তা ভিডিও’তে দেখা যায়। পরিচয় গোপন রাখতে এদের মধ্যে কয়েকজনের মুখও বাঁধা দেখা গেছে।
স্থানীয়দের হাতে আকবরের আটক হওয়ার কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব ভিডিও’র একটিতে আকবরকে বসিয়ে রেখে হাত-পা বাঁধছিলেন স্থানীয়রা। এ সময় আকবর বলছিল, ‘আমি ভাগমু না ভাই, আমি ভাগমু না।’ তখন খাসিয়াদের একজন তার নাম জানতে চাইলে সে বলে, ‘আমি আকবর।’ তখন স্থানীয়রা বলাবলি করতে থাকে, ‘১০ হাজার টাকার জন্য তুমি মানুষ মারছো’, ‘তুমি রায়হানরে হত্যা করছো’। আকবরকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি মারি নাই, আমি হাসপাতালে নিয়া গেছি।’ এ সময় আকবরের বেশভূষা ছিল অনেকটা স্থানীয়দের মতোই। গলায় পুঁতির মালা, খয়েরি রঙের শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা ছিল সে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে তাকে স্থানীয়দের মতোই লাগছিল। স্থানীয়রা পরে তাকে হাত ও পা বেঁধে হাঁটিয়ে পাহাড় ও জলাভূমি পার করে নিয়ে আসে। এ সময় স্থানীয়রা তাকে পানির বোতল দেয় এবং যারা তাকে নিয়ে আসছিল তাদের আকবরকে না মারার পরামর্শ দিতেও শোনা যায়।
অপর একটি ভিডিওতে আকবরকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি খুনি না, আমি মারিনি। ইচ্ছা করে মারিনি। আমি একা মারিনি, পাঁচ-ছয় জন তাকে মেরেছে। আমি তো হাসপাতালে নিয়া গেছি। সেখানে সে মারা গেছে।’
আকবরকে বলতে শোনা যায়, ‘সে (রায়হান) ছিনতাই করেছিল, তাকে পাবলিকে মারছে। আমি তো হাসপাতালে নিয়া গেছি।’ এ সময় স্থানীয়রা তাকে প্রশ্ন করে, তাহলে তুমি পালালে কেন? তখন আকবর বলে, ‘আমার দুই সিনিয়র আমাকে বলেছে, যেহেতু সাসপেনশন হয়েছ, আপাতত পালিয়ে যাও। দুই মাস পর ঠান্ডা হলে এসো। তখন বিষয়টা হ্যান্ডেল করা যাবে।’
অপর এক ভিডিওতে দেখা যায়, পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় আকবর দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয়দের কাছে আকুতি জানিয়ে বলছেন, ‘তোমরা বলো আমাকে মারবা না, বলো ভাই আমাকে মারবা না।’ তখন স্থানীয়রা বলতে থাকে, ‘না বসো, তোমাকে মারবো না। তোমার লাখান আমরা মারবো না।’ এ সময় আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘চুপচাপ বসো, নয় তো নিচে ফেলে দেবো’।
অথচ, সিলেট জেলা পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন বলছেন-আকবরকে কেউ আমাদের কাছে হস্তান্তর করেনি। পুলিশই তাকে ধরেছে।
এখন প্রশ্ন হলো-পুলিশ যদি আকবরকে গ্রেফতার করে থাকে তাহলে ভিডিওগুলো কোথা থেকে আসলো? খাসিয়ারা তাকে পেল কোথায়? তারপর, পুলিশ সুপারের কথা যদি সত্য হয়-তাহলে আকবরকে পুলিশ গ্রেফতার করার পর স্থানীয় খাসিয়ারা নিয়ে রশি দিয়ে বেধে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল? পুলিশের হাত থেকে তারা আকবরকে নিয়ে এসব ভিডিও করলো কিভাবে? পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন কি এসব প্রশ্নের জবাব দেবেন?
আকবরকে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন সিনিয়র এক অফিসার
আকবরকে ধরার পর স্থানীয়দের ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায় স্থানীয় খাসিয়ারা আকবরের পালিয়ে বেড়ানোর কারন জানতে চায়। জবাবে আবকব বলেন-এক সিনিয়র কর্মকর্তার নির্দেশে পালিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
এই ভিডিওতে আকবরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সিলেটে সিনিয়র পুলিশ অফিসাররাই তাঁকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে। আকবর নিজেই বলতেছেন, একজন সিনিয়র তাঁকে বলেছে আপাতত চলে যাওয়ার জন্য্ দুই মাস পর পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে যাবে। তারপর ঠিক হয়ে যাবে।
ধারণ করা ভিডিওতে বলতে শোনা যায়,-‘আমাকে এক সিনিয়র অফিসার বলছিলো, তুমি আপাতত চলে যাও। কয়েক দিন পর আইসো। দুই মাস পরে মোটামুটি পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে যাবে। এ কারণে আমি চলে যাই।’
গ্রেপ্তারের পর আকবর দাবি করে- রায়হানকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় আটক করা হয়েছিলো। তাকে কাস্টঘর এলাকার লোকজন গণপিঠুনি দেয়।
কানাইঘাটের ডোনা সীমান্তের খাসিয়াদের জেরার মুখে কেনো পালিয়েছিলো প্রশ্নের জবাবে সে জানায়- সাসপেন্ড করছে, এরেস্ট করতে পারে। এ কারণে পালিয়েছিলাম।
কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তের মাঝের গাওয়ের ওদিকে ভারতে পালিয়েছিলো বলে জানায় আকবর। ওখানে তার এক পরিচিত পরিবার রয়েছে বলে দাবি করে সে।
গত ১১ অক্টোবর ভোরে নগরীর আখালিয়ার নেহারিপাড়ার যুবক রায়হানকে পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এরপর ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে ১২ অক্টোবর রাতে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এামলার পরই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটুচন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত এবং এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়।
১৩ অক্টোবর বিকেল থেকে আকবর ছিলেন পলাতক। ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত আকবর পুলিশ ব্যারাকেই ছিলেন। পরদিন থেকে তদন্ত কাজ শুরু করে পিবিআই। ১৫ অক্টোবর রায়হানের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করে পিবিআই। ওইদিনই শেষে বিকেলে আবার আখালিয়া নবাবী মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে রায়হানের মৃতদেহ ফের দাফন করা হয়।
প্রথম দফা ময়না তদন্তের রিপোর্টে নির্যাতনের কোন বিষয় উল্লেখ করা হয়নি। তবে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের রিপোর্টে রায়হানের শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন ও হাতের দুই আঙুলের নখ উপড়ানোসহ নির্যাতনে মৃত্যু ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
পালাতে সহায়তা করার অভিযোগে আকবরের অধীনস্থ বন্দরবাজার ফাঁড়ির ‘টু-আইসি’ এসআই হাসান উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ২২ অক্টোবর। এ সময় পুলিশের সদর দপ্তরের তদন্তে আকবরকে পালাতে সহায়তাকারী একজন সিনিয়র অফিসারের নামও আসে।