অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
অবশেষে ভেস্তে গেল সরকারের সকল অপকৌশল। হালুয়া-রুটি, বিরিয়ারি আর সনদ কোনোই কাজে আসলো না। এর সাথে বঙ্গোপসাগরের পানির সাথে ভেসে গেছে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সকল চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র আর কুটকৌশল। শত চেষ্টা করেও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী হাটহাজারী মাদরাসাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না।
কিছু দিন আগে জোরপূর্বকভাবে মাদরাসাটির নায়েবে মোহতামিমের দায়িত্ব থেকে আল্লামা জুনাইদ বাবনগরীকে বাদ দিয়ে শেখ আহমদকে আহমদ শফীর উত্তরসূরী হিসেবে বসিয়েছিলেন।
ওই সময়ই অ্যানালাইসিস বিডির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, সরকার পরিকল্পিতভাবে মূলত হেফাজতে ইসলামকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই বাবুনগরীকে বাদ দিয়েছে।
কিন্তু সরকারের দালাল হিসেবে পরিচিত আহমদ শফী ও তার ছেলে আনাস মাদানীর কর্মকাণ্ড এমন বেপারোয়া হয়ে গিয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত মাদরাসাটির ছাত্ররা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে।
গত দুইদিনের টানা বিক্ষোভের মুখে অবেশেষে আহমদ শফী ও তার ছেলে আনাস মাদানী সরে দাড়াতে বাধ্য হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুধবার রাতে আনাস মাদানীকে মাদরাসার সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার আহমদ শফী বললেন-তিনি ভুলে সই করেছেন। তার ছেলেকে আবার পুনর্বহালের দাবি জানান তিনি। এরপরই ছাত্ররা আবার বিক্ষোভে নামে। সর্বশেষ বিক্ষোভের মুখে আহমদ শফী নিজেও সরে দাড়াতে বাধ্য হন।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার আনাস মাদানীকে স্বপদে পুনর্বহাল করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বহু চেষ্টা করা হয়েছে। মাদরাসা পরিচালনা কমিটির উপর হাছান মাহমুদ অনেক চাপও সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু, ছাত্রদের ব্যাপক বিক্ষোভের কারণে তার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।
সরকারের আশঙ্কা ছিল ভবিষ্যতে জুনায়েদ বাবুনগরী মহাপরিচালক হলে হেফাজতে ইসলামের আবার নতুন করে উত্থান ঘটবে। বাবুনগরী যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাই তখন হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে পড়বে। এই আশঙ্কা থেকেই হাছান মাহমুদ জুনায়েদ বাবুনগরীকে সরিয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য দিয়ে পরিচালনা কমিটির উপর চাপ সৃষ্টি করে শেখ আহমদকে আহমদ শফীর উত্তরসূরী করেছিলেন।
কিন্তু, হাছান মাহমুদের সেই স্বপ্ন আর বেশিদিন টিকে থাকলো না। তুমুল বিক্ষোভের মাধ্যমে ছাত্ররা হাছান মাহমুদের সব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ভন্ডুল করে দিয়েছে।
উল্লেখ্য ফ্যাসিবাদের দোসর হিসাবে পরিচিত আল্লামা আহমদ শফির পুত্র আনাসের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও সরকার থেকে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার গুঞ্জন ছিল ২০১৩ সালের ৫ মে’র শাপলা ট্র্যাজেডির পর থেকেই। সরকারি প্রশাসনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় তাঁর স্বেচ্ছাচারিতায় অতীষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র এবং শিক্ষকগণ। দিনে দিনে চাপা ক্ষোভ বাড়তে থাকে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটে গত সোমবার দুপুর থেকে। আনাস মাদানীর পদত্যাগসহ ৬ দফা দাবিতে সোমবার দুপুরের পর থেকে শুরু হয় ছাত্র বিক্ষোভ। বিক্ষোভ ক্রমেই বিস্ফোরিত হতে থাকলে সোমববার সন্ধ্যার পর জরুরী বৈঠক ডাকেন মাদ্রাসাটির মুহতামিম আল্লামা আহমদ শফি। আনাস মাদানীকে স্থায়ী বহিস্কারসহ ছাত্রদের দু’টি দাবি মেনে নেয়ার ঘোষনা আসে জরুরী শুরা বৈঠক থেকে। বাকী চার দাবীর বিষয়ে শনিবার শুরা বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়। বাকী চার দাবীর মধ্যে ছিল আনাস মাদানীর স্বেচ্ছারিতায় নিয়োগ দেয়া অযোগ্য শিক্ষকদের অপসারণ, মাদ্রাসা থেকে চাকুরিচ্যুত শিক্ষকদের পুনর্বহাল ও আল্লামা আহমদ শফিকে মুহতামিমের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে সম্মানজনক কোন অবস্থানে রাখা।
ছাত্রদের প্রথম দাবীসহ ২টি দাবী মেনে নেয়ার ঘোষণা দিলে প্রথম দিন বিক্ষোভ সাময়িক স্থগিত করা হয়। এবং বাকী দাবী গুলো না মানা পর্যন্ত মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার ঘোষনা দেয়া হয়। কিন্তু পরের দিন সকালে (গতকাল) আল্লামা আহমদ শফি কতিপয় শিক্ষকদের ডেকে জরুরী বৈঠকে করে মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষনার চেষ্টা করেন। এছাড়া তিনি বলেন, আগের রাতের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তাঁর শরীরের অবস্থা ভাল ছিল না। আনাস মাদানীকে বহিস্কার করা হয়নি। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আবারো বিক্ষোভে নামেন ছাত্ররা। তাৎক্ষনিকভাবে ছাত্রদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে। বিক্ষোভরত ছাত্রদের একটি অংশ আল্লামা আহমদ শফির কার্যালয় ঘেরাও করে। ছাত্ররা তখন ৬ দফা দাবী অবিলম্বে মেনে নেয়ার ঘোষণাসহ তাঁর পদত্যাগ দাবী করতে থাকেন।
এদিকে দেশের প্রাচীনতম বৃহৎ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উম্মুল মাদারিস দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে দেশের শীর্ষ উলামা-মাশায়েখগণ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আলেমগণ।
বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে তারা বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হাটহাজারী মাদরাসায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনের জন্য মাদরাসার শূরা কমিটিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং শূরার মাধ্যমেই সকল সমস্যার সমাধান করতে হবে। তবে, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীর প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিতে হবে।
উলামা-মাশায়েখগণ বলেন, এক্ষেত্রে সরকার বা প্রশাসনের কোন ধরনের হস্তক্ষেপ দেশবাসী মেনে নিবে না।
উলামা-মাশায়েখগণ আরো বলেন- অত্যন্ত দু:খজনক বিষয় যে, দেশের শীর্ষ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আল-হাইয়্যাতুল উলইয়ার আসন্ন কেন্দ্রীয় পরীক্ষার অন্যতম মারকাজ হাটহাজারী মাদরাসাকে একটি অগ্রহণযোগ্য খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে সরকার কর্তৃক বন্ধ ঘোষণা দেওয়া মাদরাসার অভ্যন্তরে অনিয়মকে মদদ দেওয়ার নামান্তর। সরকার প্রদত্ত স্বীকৃতির প্রজ্ঞাপনে উল্লেখিত দারুল উলূম দেওবন্দের অষ্ট মূলনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আমরা অনতিবিলম্বে সরকারকে এই ভুল সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
উলামা-মাশায়েখগণ আরো বলেন, আমরা পরিষ্কার বলে দিতে চাই, একটি কওমী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ অনিয়মকে জিইয়ে রাখতে সরকারের এ ঘৃণ্য পদক্ষেপ সারা দেশের কওমী অঙ্গনকে উত্তপ্ত ও ক্ষুব্ধ করে তুলবে।