– হাসান রূহী
২০১৪ সালের কথা। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারত বাংলাদেশে নিযুক্ত তাদের একজন সেবাদাসকে ‘পদ্মভূষণ’ পদকে ভূষিত করে। ‘পদ্মভূষণ’ ভারতের তৃতীয় বেসামরিক সর্বোচ্চ সম্মাননা। নিতান্ত অন্ধভাবে ভারতের দালালী না করলে এই পদক পাওয়া অসম্ভব। আর বাংলাদেশের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা এমন একজন ভারতপ্রেমিক মানুষই হলেন সদ্য প্রয়াত আনিসুজ্জামান। ভারতপ্রেমিক হবেন তার জন্য এটা মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ তিনি জন্মেছেন পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে। জন্মভূমির জন্য তিনি তার প্রাণোৎসর্গ করবেন এটাই স্বাভাবিক।
পশ্চিমবঙ্গে জন্মলাভ করলেও নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ নাস্তিক দাবি করা এই ব্যক্তি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুস্তান ছেড়ে ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিলেন। অসাধু উপায়ে নিজের জন্মস্থান খুলনা দেখিয়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
যাইহোক, আনিসুজ্জামানের পদ্মভূষণ লাভের বিষয়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার কণ্ঠে কথা বলতেন তাদের মধ্যে অন্যতম রাজনীতিবিদ ছিলেন প্রয়াত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরি। কোন প্রকার রাখঢাক না রেখেই তিনি স্পষ্ট ভাষায় কথা বলে আনন্দবাজারি দালাল মিডিয়ার চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। আজ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্য কেঁদে যেসব মিডিয়া নাকের আর চোখের পানি একাকার করছে সেই মিডিয়াগুলোই কটাক্ষ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরিকে সাকা চৌধুরি বলে সম্বোধন করতো। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিতর্কিত ট্রাইব্যুনালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। সেখানে মিথ্যা সাক্ষী দিতে সবার প্রথমে যিনি উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, আনিসুজ্জামান। প্রথম সাক্ষী দিতে ছুটে আসলেও তিনি কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন না। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দিয়ে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন- “আমি ট্রাইব্যুনালকে বলেছি যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী – যে হিন্দু ছিল – সে আমাকে বলেছিল যে ১৯৭১ সালে তার (আনিসুজ্জামানের প্রাক্তন শিক্ষার্থীর) চোখের সামনে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপস্থিতিতে এসকে চৌধুরী চট্টগ্রামের কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের নূতন সিংহকে গুলি করে হত্যা করে।”
কী ভয়ানক সাক্ষী! একজন প্রাক্তন হিন্দু শিক্ষার্থী তাকে ১৯৭১ সালে বলেছিল আর তিনি তা সাক্ষ্য দিতে ২০১২ সালে তা সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে দৌঁড়ে ছুটে এলেন! আনন্দবাজারি সাংবাদিক মহল অবশ্য তাকে তার কাছে অভিযোগকারী কথিত শিক্ষার্থীর নাম পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে সাহস করেনি। এটাও বলতে পারেনি যে, সাক্ষী দিতে তাহলে সেই শিক্ষার্থীকেই ডাকুন, যে কিনা প্রত্যক্ষদর্শী! আনিসুজ্জামানের ২০১২ সালের এই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের ১ লা অক্টোবর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। আর এর মাত্র কয়েক মাস পরেই ২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসে পদ্মভূষণ পদকের জন্য আনিসুজ্জামানের নাম ঘোষণা করে ভারত! শুধুমাত্র পদ্মভূষণই নয়। এ ছাড়া তিনি দুবার আনন্দবাজার পত্রিকার ‘আনন্দ পুরস্কার’, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডি-লিট’, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জগত্তারিণী’ পদকসহ ভারত থেকে অনেক পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন।
প্রথম আলো আজ আনিসুজ্জামান স্মরণে লিখেছে- ‘আনিসুজ্জামান যোগ দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। ’ কিন্তু প্রথম আলো বলেনি কিভাবে যুদ্ধ করেছিল আনিসুজ্জামান। তবে সেসময়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদ। তিনি লিখেছেন- ‘… তিনি কলকাতায় গড়েছিলেন এ দেশ থেকে কলকাতায় যাওয়া গায়ক-গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে একটি দল। তিনি তাদের নিয়ে ঘুরেছিলেন সারা উত্তর ভারতে। তার লক্ষ্য ছিল নাচ-গান-অভিনয়ের মধ্য দিয়ে উত্তর ভারতে-বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ইন্দিরা গান্ধী যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার পক্ষে জনমত গঠন। এ সময় উত্তর ভারতে জনমত বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনুকূলে ছিল না। তারা মনে করছিলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যেয়ে ভারতের উচিত হবে না কোনো বড় রকমের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া।
… জানি না আনিসুজ্জামান তার দল নিয়ে উত্তর ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে জনমত গঠনে কতটা সাফল্য পেয়েছিলেন। কেননা, বাংলা গান উত্তর ভারতে কেউ বোঝে না। সুরের দিক থেকেও পছন্দ করে না। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘জনগণমন’ গান পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের আর সব প্রদেশে গাওয়া হয় হিন্দি অনুবাদে। তাই বাংলা গান দিয়ে লোক জাগানো সম্ভব নয় উত্তর ভারতে। আনিসুজ্জামান সাহেব ও তার নাচ-গান-অভিনয়ের সাথীরা ভালোই ছিলেন ভারতে। তারা ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে ভালো খেয়েছেন, পরেছেন এবং থেকেছেন ভালো হোটেলে।’
ধর্ম নিয়ে বাংলাদেশের যে কয়েকজন আত্মস্বীকৃত নাস্তিক অ্যালার্জি প্রদর্শন করেছেন আনিসুজ্জামান তাদের মধ্যে অন্যতম। যদিও মৃত্যুর পর তাকে ধর্মীয় রীতি মেনে দাফন করা হয়েছে। কিন্তু তিনি প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাতকারে বলেছিলেন- ‘১৯৫২ সালের শেষদিকে আমার ধর্মবিশ্বাস চলে যায়।’ জনপ্রিয় কলামিস্ট মিনার রশীদ লিখেছেন- ‘সেই যে ১৯৫২ সালে চলে গিয়েছিল, সেই ধর্মবিশ্বাস শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত আর ফিরে এসেছিল বলে জানা যায়নি।’
এমন একজন মহান অধ্যাপকের বিদায়ে বাংলাদেশের মানুষ কতটা ব্যথিত কিংবা শোকাহত হয়েছে তা দেখার দায়িত্ব মিডিয়ার নয়। মিডিয়া তাকে আপাতত মহান বলেই প্রচার করছে। হয়তো আরও কিছুদিন করবে। যদি ভুল না করি তাহলে বলা যায়, এই বিলাপ, রোনাজারির দায়িত্ব এসেছে ওপাড় থেকে। আর সে দায়িত্ব কে কতটুকু নিষ্ঠার সাথে পালন করে পদ্মভূষণ কিংবা পদ্মশ্রীর মত পদক নিজের থলেতে পুরতে পারবে সেই প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকতে পারলে মন্দ কি! সময় গেলে সাধন হবে না…
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট