ডা. মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম
মঈনকে হারিয়ে ‘ব্যাচ কে-৪৮’ নিয়ে কত স্মৃতিই না এখন মনে পড়ছে। মেডিকেল কলেজের দিনগুলো রাঙিয়ে তুলেছিল আমার এই ব্যাচের প্রাণপ্রিয় বন্ধুরা।যার অনেক কিছুতেই জড়িয়ে আছে বন্ধু মঈন, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দিন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তাকে ১৫ এপ্রিল মৃত্যুমাল্য বরণ করতে হলো। আমরা হারালাম আমাদের সেই ব্যাচের প্রথম কাউকে, কোনো প্রিয়তম বন্ধুকে। বন্ধুর নামের সঙ্গে ‘প্রয়াত’ শব্দটা মনে মনে উচ্চারণ করাও যে কতটা কঠিন, কতটা কষ্টের—মঈনকে হারিয়ে তা অনুভব করছি।
আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৯১ সালে। অনেক বন্ধুর মতো মঈনের সঙ্গেও শুরুর দিনগুলোতে পরিচয় হয়েছিল। চলনে–বলনে সাচ্চা সাদামাটা মানুষ, স্বল্পভাষী, সেটুকুতেও মিশে থাকত বিনয়ের আবরণ। আর মানুষকে মুহূর্তে আপন করে নেওয়ার অপার ক্ষমতা তো ছিলই। সেই ক্ষমতাবলেই আমাকেও বন্ধু হিসেবে আপন করে নিয়েছিল মঈন। সেই বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে উঠেছিল হলে থাকার দিনে। আমরা থাকতাম শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হলে। আমি যে কক্ষে থাকতাম, তার পাশের কক্ষটিই ছিল মঈনের।
মেডিকেল কলেজের জীবনেই মঈন পরিচিতি পেয়েছিল বন্ধুবৎসল আর পরোপকারী হিসেবে। সুনামগঞ্জের ছাতকে ওদের গ্রাম। দূরের সে এলাকা থেকে ঢাকা মেডিকেলে প্রায়ই অসুস্থ মানুষ আসত চিকিৎসা নিতে। তাদের সহায়তায় সব সময় দেখা যেত এগিয়ে গেছে মঈন। আর ওর মৃত্যুর পর তো পরোপকারের নতুন নতুন দৃষ্টান্ত উন্মোচন হচ্ছে। অজানা কাহিনিগুলো শোনা যাচ্ছে উপকৃত মানুষদের মুখে। দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু ব্যাংক হিসাব নম্বরে সে নিয়মিত টাকা পাঠাত। সেসব অর্থ কারও চিকিৎসার, কারওবা পড়াশোনার জন্য। এসব সহায়তার কথা ওর চিকিৎসক স্ত্রীও এত দিন জানতেন না।
মঈনকে নিয়েই স্মৃতিচারণা করছিলাম আমাদের আরেক বন্ধু ডা. মো. মোহসিন উদ্দিনের সঙ্গে। যুক্তরাজ্যের একটি হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ইউরোলজিস্ট মোহসিন ছিল মঈনের রুমমেট। মেডিকেল–জীবনে ওর ‘রিডিং পার্টনার’ তো বটেই, সবচেয়ে কাছের বন্ধুও ছিল মঈন। কত কত স্মৃতির কথাই বলল সে। সেসব স্মৃতিতে একজন বিনয়ী বন্ধু আর একজন বিনয়ী চিকিৎসককেই পাওয়া গেল।
মঈন ছিল সব কাজের কাজি। রাজনীতিসচেতন, ক্রীড়ামোদী, সাম্প্রতিক বিষয়ে প্রখর জ্ঞান—প্রতিটি বিষয়ে সম্পৃক্ত থেকেও পড়াশোনাতেও ছিল ভালো। মোহসিন যেমনটা ওর পড়াশোনা সম্পর্কে বলে, পরীক্ষার আগের রাতে মোহসিন হয়তো দিনমান মনোযোগী হয়ে পড়াশোনা করছে, ওদিকে মঈন সময় পার করছে তার নিয়মিত রুটিনে। রাতের বেলা হয়তো রুমে এসে ঘণ্টা দুই পড়াশোনা করে পরদিন বসত পরীক্ষায়। তাতে কিন্তু পরীক্ষায় খারাপ না করে বেশ ভােলা ফলই করত।
আমরা মেডিকেল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে কর্মজীবন শুরু করলাম। কিন্তু যোগাযোগ কখনো থেমে যায়নি। গত মাসেই মঈনের খুদে বার্তা পেয়েছিলাম। উদ্বেগের সঙ্গে সে বলেছিল পিপিইর কথা। আমি যেন দ্রুত কিছু পিপিই পাঠিয়ে দিই। সেই প্রক্রিয়া শুরু করতে না করতেই শুনলাম মঈন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।
৭ এপ্রিল হঠাৎ তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে রাতেই তাকে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সিলেটে শহরের বর্তমানে নামী চিকিৎসকদের একজন হিসেবে তো নয়ই, দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবেও সে তার প্রাপ্য চিকিৎসা–সুবিধা পায়নি। শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকলে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো, সে–ও কত কাঠখড় পুড়িয়ে, একটা সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সে। অথচ তার প্রয়োজন ছিল আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের। আমরা কেউ তার জন্য ব্যবস্থা করে দিতে পারিনি।
মঈন তার নিজের অবস্থা বুঝতে পেরেছিল, বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল। নিজেই খোঁজ নিচ্ছিল আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের। আর যতক্ষণে তাকে আনা হলো ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে, ততক্ষণে তো দেরি হয়ে গেছে। সম্মিলিত উদ্যোগেও আর ফেরানো গেল না মঈনকে, আমাদের সদা বিনয়ী বন্ধুকে। (অনুলিখিত)
লেখক: প্রয়াত ডা. মঈন উদ্দিনের বন্ধু এবং এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের পরিচালক।