অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
‘তোমার সাথে কথা আছে’। ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই ডেকেছে তাই সরল মনে তার সাথে হেঁটে চলা। কথা বলতে বলতে আমাকে সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়ার দ্বিতীয় তলায় ছাত্রলীগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ দেয়া অফিসের পাশে একটা ছোট্ট কক্ষে নিয়ে যায় (সেটা ওদের অঘোষিত টর্চার সেল)।
এবার সেখানে উপস্থিত ভাইয়েরা নানান ধরনের প্রশ্ন করতে থাকে, কেন সরকারের সমালোচনা করে পোস্ট করি! কেন ভার্সিটির গ্রুপে পোস্ট করি – এইসব।
কথা বলার এক পর্যায়ে পিছন থেকে একজন ‘জঙ্গি কই’ ‘জঙ্গি কই’ বলতে বলতে এসে মারতে শুরু করে। এদের মধ্যে উচুঁ মারমা (আইন অনুষদ ২৩ তম ব্যাচ ), হাসান হাবিব মুরাদ( আইন অনুষদ ২৪ তম ব্যাচ), তানভীর হোসেন সাকিব (ইইই, ১১তম ব্যাচ), মিফতাউল হাসান আনাস (ইইই,১১ তম ব্যাচ) সহ ৮-১০ জন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী উপর্যুপরি মারতে থাকে। একপর্যায়ে আমার চোখের পাশ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে।
এভাবেই নিজের সাথে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকনোমিকস এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ৬ষ্ঠ ব্যাচের ছাত্র মারুফুল হাসান।
তিনি গত ২১ জুলাই ২০১৯, মাস্টার্সের ভর্তি সংক্রান্ত কাজে সকাল ১১ টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ওয়েল ফেয়ার এন্ড স্টাফ ডেভেলপমেন্ট বিভাগের অফিস থেকে তাকে ধরে নিয়ে যান একই ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র রবিউল ইসলাম রনি।
মারুফের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে একদল অবৈধ ছাত্র জোর করে প্রবেশ করে এবং তারা আজ পর্যন্ত হলেই বসবাস করছে। তারা ছাত্রলীগের নামে হলে ফ্রি খাওয়া, ছাত্রদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় জোর করে টাকা আদায়, হল রেন্ট না দিয়ে হলে থাকা, যেকোন সময় বিভিন্ন অজুহাতে ছাত্রদের মারধর-নির্যাতন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবি, তাদের কক্ষ ভাংচুরসহ নানা ধরনের অছাত্রসুলভ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত।
তিনি আরও জানান, যারা ছাত্রলীগের নামে রাজনীতি করছে তাদের অনেকেই এর আগে শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। এমনকি উল্লেখযোগ্য নেতা হাসান হাবীব মুরাদ (আইন অনুষদ ২৩ তম ব্যাচ), আব্দুল জব্বার নাঈম (ইইই, ১৩ তম ব্যাচ), সাকিব বিন কবির (ইটিই), রবিউল ইসলাম রনি ( ইকোনমিকস এন্ড ব্যাংকিং, ২য় ব্যাচ) তাদের সবাই ব্যক্তিগতভাবে ও পারিবারিকভাবে বিএনপি জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত।
মারুফ অভিযোগ করে বলেন, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর থেকে শুরু করে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান পর্যন্ত সংবাদ পৌঁছে যায়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অফিস থেকে তাকে ডেকে নেওয়া হয় এবং সিসিটিভি ফুটেজেও এরকম ঘটনার প্রমাণ ছিল। ঘটনা সবাই জানার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়ায় যেখানে তাকে প্রচণ্ড মারধর করা হচ্ছিল সেখানে কোন শিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ উপস্থিত হননি।
মারধরের একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনভুক্ত ছাত্র এম্বাসেডর (আবু নাসের জুয়েল, সাবেক সদস্য,কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ) সেখানে গেলে তার সামনেই উপস্থিত ছাত্রলীগ নেতারা তাকে অমানবিক নির্যাতন করে। পরে এম্বাসেডর এর সামনেই নেতারা শাসিয়ে দেন নিচে গিয়ে মারধরের ব্যাপারে কাউকে না বলতে।
পরে ছাত্রলীগ নেতা মিফতাউল হাসান আনাসকে দায়িত্ব দেয়া হলে সে মারুফকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গেইটে গিয়ে একটি দোকানে বসে নাস্তা করে তারই মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে বিল পরিশোধ করে। এবং গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে লোকাল বাসে উঠিয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিকস এন্ড ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের সাথে কথা বললে তিনি এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, মারুফই একমাত্র না আওয়ামীলীগ সরকার তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্যাম্পাসে মারামারি ও নির্যাতনের মাত্রা অনেক বেড়েছে। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরেও ছাত্রদের ওপর এমন নির্যাতনে সবাই ভীত ও শংকিত। তিনি সকল ক্যাম্পাসে সকল ধরনের রাজনৈতিক নিপীড়নমূলক সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধের ব্যাপারে মতামত ব্যক্ত করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আই আই ইউ সির এক শিক্ষক বলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির চর্চা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেউ যদি রাজনীতির চর্চার বদলে ভিন্নমত পোষণকারী কাউকে দমন করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে সেটি অগ্রহণযোগ্য। আর এমন অগ্রহণযোগ্য কাজ নির্বিঘ্নে করার জন্য কেউ যদি টর্চারসেল গড়ে তোলে তা সত্যিই উদ্বেগের ব্যাপার। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ বর্বর হয়ে বের হোক তা আমরা চাই না। দেশের মানুষও চায় না।