মুসাফির রাফি
বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে মানবাধিকার লংঘনের যে ভয়াবহ নজির দেখা যাচ্ছে তা সাম্প্রতিক ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হয়েই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এক একটি মানবাধিকারের লংঘনের ঘটনা হলো মানবতা আর মানবিতার পরাজয়েরই নামান্তর।
শোকাবহ মানুষের জন্য ঈদটাও যেন পুর্নমাত্রায় আনন্দ নিয়ে আসতে পারেনা। যেই মায়ের বুকে সন্তান হারানোর আহাজারি, যে পিতার কাঁধে সন্তানের লাশের গুরু বোঝা, যেই শিশুরা পিতা হারানোর কারনে ঈদের নতুন জামা থেকেও বঞ্চিত হয়, তাদের কাছে ঈদ আর অন্য দশটা সাধারন দিনের মতই।
ঈদ শেষ হয়ে মানুষ তখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরেনি। কিন্তু এরই মাঝে যে খবরটা মেইনস্ট্রিম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে উঠলো তাহলো জেনারেল আজীজ আহমেদের বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তি।
আজীজ আহমেদ সর্বশেষ সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেনাবাহিনীতে ভারতঘেষা হিসেবে পরিচিত এই কর্মকর্তা বিডিআর বিদ্রোহের পর পুনর্গঠিত বিজিবির প্রথম মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এই বিদ্রোহের পর সবচেয়ে বেশী সময় অর্থাৎ ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিজিবির মহাপরিচালক ছিলেন। তার পরামর্শেই বিডিআর বিদ্রোহ মামলাগুলো সরকার ভিন্নখাতে নিয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। ৫ মে ২০১৩ তারিখে রাজপথে হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার নিরীহ মানুষের উপর গনহত্যা চালানোর মূল নায়ক তিনি বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।
এরকম একজন বিতর্কিত মানুষকে জনগনের আস্থা ও ভরসার শেষ জায়গা অর্থাৎ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সরকার মানবাধিকারের কফিনে শেষ পেরেকটাও ঠুকে দিলো। আজীজ আহমেদকে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে সরকার মানুষ হত্যায় তার রক্তাক্ত হাতকে ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। এই ধরনের মানুষকে যেখানে চাকুরী থেকে সরিয়ে দেয়া দরকার ছিল সেখানে তাকে সর্বোচ্চ পদে প্রোমোশন দিয়ে সরকার ভিকটিম পরিবারগুলোর সাথে বড় আকারের তামাশা করলো।
তাছাড়া এই আজীজ আহমেদের আপন ভাই হলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ যিনি মাত্র কয়েকদিন আগে রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা পেয়ে খুনের মামলা থেকে অব্যহতি পেয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আজীজ-জোসেফ ভাতৃদ্বয়ের আরেক ভাই হলেন হারিস আহমেদ। যিনিও একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। তাদের আরেক ভাই হলেন সাইদ আহমেদ তিনিও সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত এবং ১৯৯০ সালে প্রতিপক্ষের গুলিতে তিনি নিহত হন।
এরকম খুনী ও সন্ত্রাসী একটি পরিবারের সদস্যকে সেনাপ্রধান বানিয়ে সরকার জাতির আশা আবেগের দিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েছে। আজীজ আহমেদের নিয়োগের পর সর্বত্র সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় বইলেও সরকার তাতে কর্নপাত দিচ্ছেনা। ধারনা করা হচ্ছে, ভারতের সুপারিশে এবং আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করবে- এমন আশ্বাসের বিনিময়েই আজীজকে এই পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
আরেকটি ঘটনা যেটা সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত হয়েছে সেটা হলো আপন ভাইয়ের মৃত্যুর পরও কারাবন্দী মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীকে প্যারোলে মুক্তি না দেয়ার সরকারী সিদ্ধান্ত। সাঈদী সাহেব জেলে আছেন প্রায় ৮ বছর। এই ৮ বছরের মধ্যে তার বড় ছেলে, তার মা এবং সর্বশেষ তার ছোট ভাই মারা গেলেন। কারাবন্দী জীবনের কষ্টের বাইরে এই কষ্টগুলো নি:সন্দেহে তার জন্য বহন করা রীতিমতো অসাধ্য। মা ও ছেলের বেলায় সাঈদী সাহেবকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়েছিলো এবং তিনি নিজেই তাদের জানাজায় ইমামতি করেছিলেন।
কিন্তু এবার দেবো দেবো আশ্বাস দিয়েও সরকার তাকে শেষ পর্যন্ত আর মুক্তি দেয়নি। মানুষের মৃত্যু এমন একটা বিষয় যেখানে কোন রাজনীতি বা দলীয় বিবেচনা চলেনা। যেখানে একটি বিষয়ই শুধু বিবেচনা পায় আর তা হলো মানবিকতা। কিন্তু এবার সেই নুন্যতম মানবিকতাও দেখাতে ব্যর্থ হলো সরকার। ফলে সরকারের রাজনৈতিক একগুয়েমীতে আরেকবার হার মানে মানবতা।
দুঃশাসন যখন চলে, তখন এভাবেই খুনী দেশ ছাড়ার সুযোগ পায়, খুনীর ভাই পুরস্কার আর প্রোমোশন পায়, আর অন্যদিকে ভাইয়ের মুখটাও শেষবার দেখতে দেয়া হয়না একজন বিশ্বনন্দিত আলেমকে। ৭৪ বছরের বিধবা নারী বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে আটকে রাখা হয়। তাকে চিকিৎসার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। হাটতে পারছেননা জেনেও তাকে তার পছন্দসই হাসপাতালে নেয়া রহিত করা হয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন মাদার অব হিউম্যানিটি, তখন তার আমলে হিউম্যানিটি তথা মানবতাবোধকে তাই তামাশার একটি বিষয়ই বানিয়ে দেয়া হয়েছে।
দুঃশাসনের রাজ্যে তাই বার বার এভাবেই হেরে যায় মানবিকতা, আর জিতে যায় স্বৈরশাসন, জিতে যায় বর্বরতা।