অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
দুই দশক ধরে চলমান বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার জোট নানা চড়াই উৎরাই পার করেছে। দুই দলের মধ্যে সম্পর্ক কখনো ঘনিষ্ঠ হয়েছে কখনো আবার হয়েছে শিথিল। টানাপোড়েন ছিলো প্রায় সময়ই। কিন্তু এতকিছুর পরও জোট থেকেছে অটুট। ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর দীর্ঘদিন ধরে তারা ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। এই সময়ে ভেতরে ও বাইরে থেকে জোট ভাঙার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কিন্তু জোটের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষ করে খালেদা জিয়ার দূরদর্শিতায় জোট এখনো টিকে আছে।
বিএনপি জামায়াত জোটের প্রতি প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের প্রধান ভয়ের কারণ হলো জামায়াতের সমৃদ্ধ ভোটব্যাংক। ভোটের রাজনীতিতে বৃহৎ দুই দল বিএনপি আর আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক প্রায় সমান। প্রায় ৩৫ শতাংশ করে দলীয় ভোট রয়েছে উভয়ের। ফেয়ার নির্বাচনে তাই দু’দলেরই জয়লাভ নিশ্চিত করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। এই কঠিন অবস্থাটাকে বিএনপির জন্য সহজ করে দিয়েছে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল জামায়াতে ইসলামী। জোট গঠনের মাধ্যমে তাদের প্রায় ১০-১২ শতাংশ ভোটব্যাংক যুক্ত হয়েছে বিএনপির সঙ্গে। যেকোনো ফেয়ার নির্বাচনে এই জোটের নির্বাচনে জয়লাভ করাটা সহজ সমীকরণ হয়ে গিয়েছিলো।
আর এই সহজ সমীকরণই মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের জন্য। এই জোটকে ভাঙার জন্য উঠেপড়ে লাগেন তারা। এই প্রচেষ্টায় তাদের সঙ্গী হয়েছে প্রতিবেশি দেশ ভারতও। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ভারতের সখ্যতা সবচেয়ে বেশি। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে হলেও ভারতের স্বার্থ পূরণে সবকিছু করেছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় থাকতে এসব দিনের পর দিন করে গেছে দলটি। প্রতিদান স্বরুপ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনসহ আওয়ামী লীগের সকল অন্যায় কর্মকাণ্ডের নির্লজ্জ সমর্থন দিয়েছে প্রতিবেশি এই মোড়ল রাষ্ট্রটি।
এ বছরের শেষদিকে বাংলাদেশে একাদশ সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সেই নির্বাচন নিয়ে আবারও দেশি বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র বাসা বাঁধছে দেশের রাজনীতিতে। সমর্থন অব্যাহত রাখতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা কয়েক দফা ভারত সফর করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও সফর করে এসেছেন। ভারতকে এ পর্যন্ত অনেক কিছু দিয়েছেন, এবার ভারতের কাছে তার প্রতিদান হিসেবে ফের ক্ষমতা চান শেখ হাসিনা, সফরকালে এমন খবরও এসেছে ভারতীয় পত্রিকায়।
এদিকে দৌড়ঝাঁপে পিছিয়ে নেই বিএনপিও। আমির খসরুর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বর্তমানে ভারত সফরে রয়েছেন। বিএনপির সাথে বরাবরই ভারতের সম্পর্ক তেমন ভালো ছিলো না। তবে এবার বিএনপির পক্ষ থেকে বার্তা ছিলো অতীত ভুলে যেতে হবে। তাদের বক্তব্য, ‘পেছনে না তাকিয়ে আমাদেরকে সামনে তাকাতে হবে। ৮০ ও ৯০’র দশকের রাজনীতি এখন দৃষ্টিসীমার বাইরে।’ তারেক রহমানের পক্ষ থেকে বিএনপির বার্তা ছিলো, ভারত যদি একটি বিশেষ দলকে অন্যায়ভাবে সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখে তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকবে না এবং চরমপন্থার উদ্ভব ঘটবে। যা প্রতিবেশি দেশ হিসেবে ভারতের জন্যই হুমকী।
তিন সদস্যের বিএনপির প্রতিনিধি দলটি মিলিত হয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম জে আকবর, জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী এবং শাসক বিজেপি সমর্থক ‘শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ফাউন্ডেশনের’ অধিকর্তা অনির্বাণ গাঙ্গুলির সঙ্গে। তবে এই সাক্ষাৎকারগুলো বিএনপি প্রতিনিধি দলের কেউ স্বীকার করেননি। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দফতর, রাহুল গান্ধীর সচিবালয় এবং বিজেপি দলের থেকে বৈঠকগুলোকে নিশ্চিত করা হয়েছে। ভারতের শাসক বিজেপি দল বাংলাদেশের বিএনপি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বার্তালাপের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল শ্রী গাঙ্গুলিকে।
বাংলাদেশের কিছু পত্রিকায় বিএনপির প্রতিনিধিদের এই সফর নিয়ে কিছু বিভ্রান্তিকর খবরও প্রকাশিত হচ্ছে। এসব খবরে বলা হচ্ছে, বিজেপি এবং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভারতীয় জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ পরিত্যাগ করতে হবে এবং সাধারণ নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ করতে হবে। যদিও এসব খবরের কোনো সঠিক উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে এমন খবরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন ভারতের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য সত্য হয়ে থাকলে তা হবে খুবই দুঃখজনক একটি ব্যাপার। কারণ প্রতিবেশি দেশ বলেই অন্যদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অধিকার ভারতের নেই। কে কার সঙ্গে জোট করবে সেটার পরামর্শ দেয়ারও তারা কেউ না। জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশের কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি বৈধ রাজনৈতিক দল। তারা ইতোপূর্বের কয়েকটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং জণগনের ভোটে দলটির বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন। এমনকি দলটির দু’জন শীর্ষ নেতা মন্ত্রীও হয়েছিলেন, যারা দুর্নীতিমুক্ত মন্ত্রীত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এমন একটি দলের বিরুদ্ধে বিষোধগার প্রতিবেশি দেশের পক্ষ থেকে কখনোই কাম্য হতে পারে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি জামায়াত জোট ভাঙার ষড়যন্ত্র চলছে বহু আগে থেকেই। বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার জন্য জামায়াতকেও বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। ব্যর্থ হয়ে দলটির নেতাদেরকে বিতর্কিত বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। কিন্তু মহলটি এরপরও ক্ষান্ত দেয়নি। তাদের ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত রেখেছে। দেশি বিদেশি এই ষড়যন্ত্রে বিএনপি যদি পা দেয় তাহলে এটি তাদের জন্য এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে।
বাংলাদেশে ভারতের একক আধিপত্য ও কর্তৃত্ব বিস্তারে একমাত্র বাধা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি। সব দলকে ক্ষমতায় বসানোর লোভ দেখিয়ে পক্ষে আনা গেলেও এই দলটিকে আনা সম্ভব নয়। যা তারা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে। এজন্য জামায়াতকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন প্রমাণের জন্য সকল ধরণের অপপ্রচার তারা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ইন্ধনেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলটির শীর্ষ ৫ নেতার ফাঁসি কার্যকর করেছে। পুরস্কার হিসেবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা বিতর্কিত নির্বাচনকে তারা স্বীকৃতি দিয়েছে এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করেছে।
ভারত যদি এভাবে একতরফাভাবে একটি দলকে অন্যায় সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখে তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলে কিছুই থাকবে না। একদলীয় শাসন কায়েম হবে। ভিন্নমতের উপর অব্যাহত গুম-খুন, দমন-পীড়ণের মাধ্যমে যেটা ক্ষমতাসীনরা কায়েম করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে। কারন দমন-পীড়ণের ফলে বাংলাদেশে চরমপন্থার উদ্ভব ঘটলে ভারতের নিরাপত্তাও হুমকীর মুখে পড়বে। বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের উচিত তার প্রতিবেশি দেশের প্রতি যেকোনো অন্যায় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং দেশটিতে গণতন্ত্র ও শান্তি বজায় রাখতে সহায়তা করা।