অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আর মাত্র ১৫ দিন পরেই আগামী ১৫ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলই দলীয়ভাবে তাদের প্রার্থী দিয়েছে এবং প্রার্থীরা দলীয় প্রতীকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদিকে অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচন নিয়ে সরকারদলীয় প্রার্থীদের তেমন কোনো অভিযোগ না থাকলেও বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরা নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
নির্বাচনে অংশ নেয়া বিরোধী দলীয় প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। নেতাকর্মীদেরকে হয়রানি করছে। তাদের মতে, গাজীপুরের পুলিশ এখন ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম। আর এই আতঙ্কের মহানায়ক হচ্ছে এসপি হারুন। তার দাপটে গাজীপুরে সাধারণ নিরীহ মানুষরা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বিরোধী দলের তরুণ কর্মীরা কেউ প্রচারণায় অংশ নেয়াতো দূরের কথা, গাজীপুরে অবস্থান করতেই পারে না।
গাজীপুরের জামায়াত সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী অধ্যাপক সানাউল্লাহ গত ২৩ এপ্রিল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে বিএনপি মনোনীত মেয়রপ্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকারকে সমর্থন দেন। এরপর ২৭ এপ্রিল এক নির্বাচনী ঘরোয়া প্রোগ্রাম থেকে অধ্যাপক সানাউল্লাহসহ ৪৫ জনকে আটক করে পুলিশ। এসপি হারুন গ্রেপ্তারকৃতদের সামনে সাজানো পেট্রল বোমা ও ককটেল রেখে সাংবাদিকদের জানায় এসব বিষ্ফোরকসহ তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান বিএনপি সমর্থীত প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি দাবি করেন নির্বাচনী প্রচারণায় বাধাগ্রস্ত করতেই তাদেরকে অন্যায়ভাবে সাজানো পেট্রলবোমা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এসপি হারুনের অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। রোববার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই দাবি জানান। রিজভী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে দুই সিটিতে। বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হচ্ছে, এমনকি নেতাকর্মীদের বিনা কারণে গ্রেফতার করছে পুলিশ। গাজীপুরের এসপি হারুন কে নিয়ে রিজভী বলেন, আমরা শুরু থেকে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদের প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে নির্বিকার। আমি অবিলম্বে গাজীপুরের এসপি হারুনের প্রত্যাহার দাবি করছি।
অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ইউপি নির্বাচনের সময়ও সরকার দলীয় প্রার্থীদেরকে জিতিয়ে দিতে খুন হতে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করেনি এসপি হারুন। সেই নির্বাচনে গাজীপুরের শ্রীপুরে এক ইউপি সদস্য প্রার্থীকে কুপিয়ে হত্যা এবং অর্থের বিনিময়ে ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি ব্যক্তি বিশেষকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে হারুন জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের তার অফিসে ডেকে নেন এবং কে কে চেয়ারম্যান হবেন, তা তিনি আগেই ঘোষণা দেন। এনিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে হুঁশিয়ার করে দেয়ারও অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে।
ঐ সময় নির্বাচনে এসপি হারুন ও তার ঘনিষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট থানার ওসিরা প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে চেয়ারম্যান প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেন। এর পর ইসি তাদের প্রত্যাহার করে উপযুক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক তাকে গাজীপুর থেকে প্রত্যাহার করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু কয়েকদিনের ব্যাবধানে ইসিকে না জানিয়েই তাকে আবার সেখানেই পদায়ন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যা ছিলো ইউপি নির্বাচন আইনের সরাসরি লঙ্ঘণ। এভাবেই সরকার এসপি হারুনের অন্যায় অপকর্মকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
এসপি হারুনের ঐদ্ধত্যের প্রথম প্রকাশ ঘটে ২০১১ সালের ৬ জুলাই। তখন তিনি তেজগাঁও থানার সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেদিন বিএনপির সকাল সন্ধ্যা হরতাল চলাকালিন সময়ে হরতালের সমর্থনে মিছিল থেকে বিরোধী দলীয় চীপ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের উপর আক্রমণাত্মকভাবে হামলা চালান এই এসপি। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, এসপি হারুন জয়নুল আবেদিনের গেঞ্জি ছিঁড়ে ফেলেন এবং মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করেন। তখন এনিয়ে সর্বত্র সমালোচনার ঝড় উঠে। কিন্তু বিরোধী দলের চীপ হুইপের উপর এমন ন্যাক্কারজনক হামলা পর সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে পদোন্নতি ও বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করে।
বিরোধী দলীয় চীপ হুইপকে পিটিয়ে পুরস্কৃত হওয়ার পর তার ঐদ্ধত্য আরো কয়েকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অপকর্মে সীমা অতিক্রম করেছে হারুন। ধারাবাহিকভাবে চলছে তার অপকর্ম লিলা। পদোন্নতি পেয়ে গাজীপুর যাওয়ার পর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠে খালেদা জিয়াকে সমাবেশ করতে দেননি এই কুখ্যাত এসপি।
এছাড়া গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক এম.এ. মান্নান ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নেপথ্যেও তার ইন্ধন ছিল। দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের পৃথক অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে মেয়র মান্নানকে বরখাস্ত করার পেছনে তার অবদান রয়েছেন। স্থানীয়দের তথ্যমতে, চান্দনা এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরে যাওয়ার কথা প্রথমে পুলিশ স্বীকার করে। কিন্তু পরে নাশকতামূলক অগ্নিকাণ্ড দেখিয়ে মামলা দেওয়া হয়। অথচ আগুন লাগার অন্তত পাঁচঘণ্টা আগে মান্নানকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
জেলার শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা করা হয়েছে। মামলা আর হামলার ভয়ে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা ঘরছাড়া হয়েছেন। বিএনপির জেলা থেকে ওয়ার্ড- কোনো কার্যালয়ই খুলতে দেননি এই এসপি। দলীয় কর্মসূচী দূরে থাক মানববন্ধন পর্যন্ত করতে পারেনি বিএনপি। জেলা বারের আইনজীবীও এসপি হারুনের অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি।
অনুষ্ঠিতব্য সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে নতুন করে অপতৎপরতা শুরু করেছে এসপি হারুন। বিএনপি জামায়াতসহ ২০ দলের নেতাকর্মীদেরকে প্রচারণায় অংশ নেয়া তো দূরের কথা এলাকায় অবস্থান করতেই দিচ্ছে না সে। এমন অবস্থায় গাজীপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার মূল অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এসপি হারুন। এজন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অবিলম্বে তাকে গাজীপুর থেকে প্রত্যাহারের জোর দাবি জানিয়েছেন এলাকার সর্বস্তরের জনগণ।