অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সেনা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিচারের রায় ঘোষনা হলো আজ সোমবার। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ অক্টোবর ঢাকার পিলখানায় এই সেনা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। মেজর জেনারেল শাকিল আহমদ ও কর্নেল গুলজারসহ বিভিন্ন পদবীর মোট ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারকে সেদিন পিলখানায় হত্যা করা হয়। শুধু হত্যা নয়, তাদেরকে হত্যা করে লাশ ক্ষত বিক্ষত করা হয়েছিল। কারো কারো লাশ ময়লার ড্রেনে নিক্ষেপ করা হয়। একাধিক লাশ আগুনে পুড়ে ফেলা হয়। কিছু লাশ মাটি চাপা দেয়া হয় পিলখানার ভেতরে। শেষ পর্যন্ত দু’টি লাশের সন্ধান-ই পাওয়া যায়নি।
হাইকোর্ট আজ রায় ঘোষণা করে নৃসংশ এ হত্যাকণ্ডের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিলেও রাজনীতিক বিশ্লেষক, আইন বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ সচেতন মানুষ মনে করছেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সেনা হত্যকাণ্ডের রহস্য অজানাই রয়ে গেছে। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী খালাস পাওয়ায় রায় নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গণহারে বিডিয়ার সদস্যদেরকে ফাঁসি আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের নায়করা ধরা ছোয়ার বাইরে রয়ে গেছে বলে মনে করছেন তারা।
হত্যাকাণ্ডে আ.লীগ নেতা তোরাব আলীর সংশ্লিষ্টতা
সাবেক ৪৮ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন সাবেক বিডিয়ার সদস্য তোরাব আলী। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ওই দিন বিদ্রোহীদের সমর্থনে মিছিল বের করেছিলেন তোরাব আলী। এসময় তার ছেলে লেদার লিটনসহ স্থানীয়রাও ওই মিছিলে অংশ নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পিলখানার বাইরের সেই মিছিল ও সমাবেশ বন্ধ করে দেয়। এরপর তোরাব আলী ও তার ছেলে লেদার লিটনকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
জানা গেছে, সেনাবাহিনীর তদন্ত এবং সরকারের অবসরপ্রাপ্ত একজন সচিবের তদন্ত রিপোর্টেও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীর নাম উঠে আসে। তোরাব আলীর মোবাইল ফোনে পিলখানা ঘটনার সময় এবং এর আগে ভারত থেকে একাধিক ফোন আসে। তদন্তে তাঁর মোবাইল কললিস্ট জব্দ করে এ তথ্য পাওয়া যায়। তোরাব আলীর মাধ্যমেই কিলার গ্রুপ আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিম এবং জাহাঙ্গির কবির নানকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের সঙ্গে কিলার গ্রুপের একাধিক বৈঠক হয়। বৈঠকে পরিকল্পনা চুড়ান্ত হয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের পিলখানায় খুন করা হবে।
এছাড়া, আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীর মাধ্যমে খুনিরা তাপস ছাড়াও জাহাঙ্গির কবির নানক, শেখ সেলিমের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করত। তারা খুনিদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। আশ্বাস অনুযায়ী সহযোগিতা করার চেস্টাও করা হয়। যেমন- ঘটনার পর পরই সিনিয়র মন্ত্রিদের রেখে জাহাঙ্গির কবির নানককে সমঝোতার দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। নানকের নেতৃত্বেই ঘটনার পর পর পিলখানায় আসেন হুইপ মির্জা আজমসহ কয়েক জন। তারাই পিলখানা থেকে খুনের নেতৃত্বদানাকারীদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যায়। ফজলে নূর তাপস ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকালে নিজে মাইকিং করে পিলখানা সংলগ্ন ৩ মাইল এলাকা থেকে জনগনকে সরে যেতে অনুরোধ জানায়। যখন সমঝোতা হয়ে গেছে তখন মাইকিং করে ৩ মাইল এলাকা ফাঁকা করার পেছনে গুরুত্বপূর্ন রহস্য ছিল বলে বিশিষ্টজনদের ধারণা।
রিমান্ডে কী তথ্য দিয়েছিলেন তোরাব আলী?
গ্রেফতারের পর আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীকে ১৬ মার্চ আবারও দু’ দিনের পুলিশ রিমান্ডে নেয়া হয়। ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাজারীবাগ থানার এসআই রবিউল তাকে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। ঢাকার মহানগর হাকিম শামীমা পারভীন শুনানি শেষে দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। যে প্রতিবেদনসহ তোরাব আলীকে আদালতে পাঠানো হয় তাতে উল্লেখ করা হয়, আসামিকে দু’দিনের রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে বিডিআর বিদ্রোহের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। যা তদন্তের স্বার্থে গোপন রাখা হয়েছে। তার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা ও গ্রেপ্তারের নিমিত্তে আরও ৭ দিনের পুলিশ রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন।
জানা গেছে, তোরাব আলী রিমান্ডে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের অনেক নেতার কথা বলেছেন। কিন্তু, সরকার তাদেরকে গ্রেফতার না করে বিএনপি নেতা নাছির উদ্দিন পিন্টুকে গ্রেফতার করে। পরে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদলতে বিএনপি নেতা পিন্টু ও আ.লীগ নেতা তোরাব আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু রাজশাহী কারাগারে ২০১৫ সালের ৩ মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তবে, তখন অভিযোগ ছিল অসুস্থ পিন্টুকে সরকার সঠিক চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দেয়নি। আর বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ ছিল সরকার পরিকল্পিতভাবে পিন্টুকে কারাগারে হত্যা করেছে। আবার এমনও অভিযোগ উঠেছিল যে, পিন্টুকে ইনকেজশন পুশ করে মারা হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী আজ হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পেয়েছেন।
বিতর্ক ছিল তদন্ত কমিটি নিয়ে
এই হত্যাকাণ্ডের পর দু‘টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে। আরেকটি তদন্ত কমিটি সরকার গঠন করেছিল। দু’টি তদন্ত কমিটি পৃথক রিপোর্ট দিয়েছিল। তবে সেই রিপোর্ট দু’টি সরকার প্রকাশ করেনি। কার স্বার্থে, কেন প্রকাশ করেনি তা নিয়ে জনমনে শুরু থেকেই প্রশ্ন রয়েছে। তবে, রিপোর্ট দুইটির সারমর্মে বলা হয়েছিল, শুধু ক্ষোভ থেকে এ বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি। এর পেছনের নেপথ্যের নায়কদের খুজে বের করতে হবে।
পরে এ ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় বিতর্কিত এক পুলিশ কর্মকর্তাকে। আবদুল কাহহার আকন্দ নামে ওই পুলিশ কর্মকর্তা কট্টর আওয়ামী লীগার হিসাবে পরিচিত। চার দলীয় জোট সরকারের সময় বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছিল তাঁকে। তখন ওই আবদুল কাহহার আকন্দ আওয়ামী লীগের মনোনয়নের প্রত্যাশায় এলাকায় সরাসরি রাজনীতি শুরু করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন দেয়া হয়নি তাঁকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাঁকে আবার পুলিশে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে এডিশনাল এসপি পদে সিআইডিতে পদায়ন করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে তাঁকে আবারো চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে সিআইডিতে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই কাহহারকেই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব দেয়ার পর এনিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে। ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সিআইডির তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয় এঘটনার সঙ্গে কোনো রাজনীতি দলের সম্পর্ক ছিল না। ঘটনার পেছনে বাইরের কোনো ইন্ধন দাতাও ছিল না। জওয়ানদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকেই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
সিআইডির এই তদন্ত রিপোর্ট নিয়েও জনমনে তখন নানা সন্দেহ সংশয় দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাঁচাতেই সরকার সিআইডিকে দিয়ে এ তদন্ত করিয়েছে বলেও অভিযোগ ছিল।
যেসব প্রশ্নের জবাব দেশবাসী আজও জানতে পারেনি
২৫ ফেব্রুয়ারি ঘটনার প্রকাশ্য সূত্রপাত হয়েছে সকাল ৯টা ১০ মিনিটে। বিডিআর ডিজি দরবার হলে বক্তব্য রেখে কুশল বিনিময়ের পরপরই ঘটনার সূত্রপাত হয়। ৯টা ১৫ মিনিটে পিলখানার ভেতরে থেমে থেমে গুলি বর্ষণ করে করে খুনি চক্র। সকাল ১০টার মধ্যে একাধিক সেনা কর্মকর্তা সেনা সদরে উর্ধ্বতন অফিসারদের মোবাইলে অবহিত করেছেন তারা জওয়ানদের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। উদ্ধারের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। তাদের অনুরোধ অনুযায়ী উর্ধ্বতন অফিসারদের সক্রিয়তায় সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১ টার মধ্যে পিলখানার সকল গেটে র্যাব ও সেনাবাহিনীর নিয়োজিত ইউনিট পৌছে যায়। তারা ভেতরে ঢুকে অপারেশন চালানোর জন্য চুড়ান্ত নির্দেশের অপেক্ষা করতে থাকে। তারা বার বার চেষ্টা চালিয়েও চুড়ান্ত নির্দেশ না পাওয়ায় সেনা অফিসারদের উদ্ধার অভিযানে অপারেশন শুরু করতে ব্যর্থ হয়। প্রশ্ন হচ্ছে কার স্বার্থে এবং কেন অফিসারদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী এবং র্যাব প্রস্তুত থাকার পরও অভিযানের নির্দেশ দেয়া হল না?
এরপর, সেদিনের ঘটনায় স্ত্রীসহ নিহত বিডিআর ডিজি শাকিল আহমদের ছেলে রাকিন আহমদ একটি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তিনিও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তৎকালীন সেনা প্রধানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন তাঁর বাবাকে উদ্ধারে সেনা অভিযান চালানো হল না কেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন তিনি চাচ্ছিলেন সেনা বাহিনী অভিযান চালিয়ে পিলখানা থেকে অফিসারদের উদ্ধার করুক। কিন্তু সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদ সাড়া দেয়নি। অপর দিকে জেনারেল মঈন জানিয়েছেন তিনি অভিযান চালাতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেননি। এখানেও অনেক রহস্য লুকায়িত ছিল বলে মনে করছেন সচেতন মানুষ।
আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে ১৩ জন খুনিকে সেদিন বিকাল ৩টায় পিলখানা থেকে নানক এবং আজম মিলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তাদের জন্য অপেক্ষমান ছিলেন। সেখানে সেনা প্রধান মঈন উ আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। তখন কী খুনিদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল সেনা অফিসাররা কোথায়! ডিজি কোথায়? একটি বাহিনীর ডিজি ছাড়া শুধু বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা হয় কেমন করে! সেই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। পরে জানা গেছে, অনেক অফিসার তখনো বেঁচে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে ফিরে যাওয়ার পর বাকী সবাইকে খুন করা হয়।
এরপর, রাত ১টায় বিদ্যুতের আলো বন্ধ করে দেয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন পিলখানায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রবেশ করলেন কোন ভরসায়? তারা জানতেন অন্ধকারেও তাদের গায়ে কেউ আছড় কাটবে না। সেখানে গিয়ে রাতের অন্ধকারে অস্ত্র সমর্পন নাটক করা হল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইন প্রতিমন্ত্রী কী খোঁজ নিয়েছিলেন বিডিআর ডিজি কোথায় বা অন্য অফিসাররা কোথায়! খুনিদের সঙ্গেই তাদের যত বোঝাপড়া। অনেকেই মনে করেন এই বোঝাপড়া ছিল একটি সাজানো নাটক।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, পিলখানার পাশে আম্বালা রেস্টুরেন্টে খুনিদের সঙ্গে বৈঠকের পর ফজলে নূর তাপস মাইকিং করলেন কার স্বার্থে? ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৬টায় ফজলে নূর তাপস ৩ কিলোমিটার এলাকা থেকে জনগনকে সরে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন কেন? ফজলে নূর তাপসের অনুরোধে মানুষ ওই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এতে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে খুনিরা নিরাপদে পিলখানা ত্যাগ করে। খুনিদের নিরাপদে পিলখানা ত্যাগ করার সুযোগ কেন কার স্বার্থে করা হয়েছিল?
সর্বশেষ নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পাওয়ায় এ নিয়ে এখন বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও রায়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে লোকজন প্রশ্ন তুলেছে। অনেকেই বলছেন, সরকার বিএনপি নেতা পিন্টুকে হত্যা করে নিজের দলের নেতা তোরাব আলীকে খালাস দিয়েছে।
Discussion about this post