অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
মিয়ানমার সরকার দাবি করছে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে দেড়শোর মতো মুসলিম জঙ্গী এক যোগে বিভিন্ন পুলিশ স্টেশন, সীমান্ত ফাঁড়ি এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালানোর পর অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির অফিস থেকে বলা হচ্ছে, নিহতদের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ জন সদস্য রয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন একটি কমিশন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়ার পথ খুলে দেয়ার আহবান জানিয়েছে। কমিশন তাদের রিপোর্টে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সব ধরণের বিধিনিষেধ তুলে নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছিল।
কফি আনান কমিশনের এমন আহ্বানের মাত্র একদিনের মাথায় সেদেশে পুলিশ ও সেনা ক্যাম্পে কথিত এই হামলার ঘটনায় অনেক রহস্যের জন্ম দিয়েছে। এই ঘটনার সত্যতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে নাগরিকত্ব দেয়া ও তাদের বিরুদ্ধে সকল বিধি নিষেধ তুলে দেয়ার আহ্বানকে পাশ কাটাতেই রোহিঙ্গারা নাগরিক হওয়ার যোগ্য নয়, তারা সন্ত্রাসী এমনটা প্রমান করতেই সেনা ও প্রশাসন এমন কথিত হামলা ও নিহতের গল্প ছড়াতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স ও বিবিসিসহ সকল আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমই এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে সে দেশের সেনাবাহিনী ও অং সান সুচির অফিসের বরাত দিয়ে। কেউই এই ঘটনার কোনো ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করতে পারেনি। সেনা নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমারের সব যায়গায় সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। তাই আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো কোনো ছবি বা ভিডিও সংগ্রহ করতে পারেনি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো সে দেশের স্থানীয় ও সরকারি কোনো পত্রিকা বা টেলিভিশনও কোনো ছবি বা ভিডিও দেখায়নি। এমনকি সেনাবাহিনী বা পুলিশের পক্ষ থেকেও হামলার কোনো স্থান বা হামলায় আহত ও নিহত কারো ছবি প্রকাশ করা হয়নি। এজন্য এই ঘটনার সত্যতা যাছাই করা সম্ভব হচ্ছে না।
রয়টার্স বলছে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এর নামে করা একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এক পোস্টে হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে। সেই টুইটার পোষ্টে বলা হয়, “বার্মিজ নির্যাতনকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ২৫টির বেশি জায়গায় আমরা প্রতিরোধ কার্যক্রম চালিয়েছি। শিগগির আরও আসছে।” কিন্তু টুইটার বা ফেসবুকে এমন দায় স্বীকার নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে কথিত জঙ্গি হামলাগুলোতেও নামসর্বস্ব কিছু টুইটার আইডি থেকে বিভিন্ন সংগঠনের নামে দায় স্বীকার করতে দেখা গেছে, কথিত সেই সংগঠনগুলোর কোনো অস্তিত্ব পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া যেতো না। অন্যদিকে ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের পুলিশ কর্তৃক আইএসআইএস’র নামে ভুয়া ওয়েবসাইট চালানোর খবরও মিডিয়ায় এসেছে। এসব কারনে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠন কর্তৃক কথিত হামলার দায় স্বীকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। কেননা টুইটারে একটি ফেইক একাউন্ট খুলে এমন দায় স্বীকারের পোষ্ট দেয়া যে কারো পক্ষেই সম্ভব।
গত বছর রাখাইন মুসলিমদের ওপর সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনে হাজার হাজার মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। সেনা ও বৌদ্ধদের অকথ্য নির্যাতনের অসংখ্য ভিডিও ও ছবি বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের রক্তক্ষরণ ঘটায়। মুসলিম বিশ্বের নেতারা মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে অনেক বক্তব্যও দিয়েছিলেন তখন। সেসময় সেনাদের দ্বারা অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণের শিকার হয়। সেনাবাহিনীর এমন দমন ও নির্যাতন অভিযানের মুখে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান রাখাইন থেকে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংস নির্যাতনের কাহিনী প্রামাণ্য আকারে উপস্থাপন করে। কিন্তু এমন অপরাধের কথা বেমালুম অস্বীকার করে মিয়ানমার সরকার। অভিযোগ তদন্তের জন্য নিজস্ব লোকদের দিয়ে রাখাইন ইনভেস্টিগেটিভ কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্টে বলা হয়- তদন্তে সেনা কর্তৃক রোহিঙ্গাদের দমন ও নির্যাতনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি রোহিঙ্গা নারীদের গণধর্ষণের অভিযোগও পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়।
রোহিঙ্গা নির্যাতনের জলজ্যান্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সকল কিছু অস্বীকার করায় মিয়ানমার সরকার ও সেনাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, তারা যে কোনো মূল্যে সে দেশ থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতাড়িত করতে চায়। এজন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অযুহাত তুলে বা অযুহাত তৈরি করে তাদেরকে হত্যা ও দেশছাড়া করছে। এজন্য রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়ে কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের একদিন পরই এমন ঘটনা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কেননা এই ঘটনা রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে নাগরিকত্ব দেয়ার পরিবর্তে তাদেরকে দমন ও দেশ থেকে বিতাড়িত করার পথই সুগম করে দিয়েছে।
রোহিঙ্গারা আরাকানের আদি বাসিন্দা হলেও এক বিবৃতিতে কথিত হামলাকারী রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ ও বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অধিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর সু চির কার্যালয়ের প্রেস কর্মকর্তারা।
জানা যায়, রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান এক সময় স্বাধীন রাজ্য থাকলেও অষ্টাদশ শতকের শেষভাবে বার্মার রাজা ওই এলাকা দখল করে নেন। আরাকানে জাতিগত বিভেদ তখন থেকেই।
গত শতকের চল্লিশের দশকের পর আরাকানে বৌদ্ধ মগ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে বহুবার জাতিগত দাঙ্গা লেগেছে। সামরিক শাসনামলে মিয়ানমারে ওই রাজ্যে চলেছে দফায় দফায় দমন অভিযান। রোহিঙ্গাদের বিভিন্নসংগঠন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পথেও হেঁটেছে।
মিয়ানমারে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে গত শতকের ৮০ এর দশক থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। তাদের ফিরিয়ে নিতে বার বার আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমারের সাড়া পাওয়া যায়নি।
Discussion about this post