পি কে বালাচন্দ্রন
ভারতের মুসলমানরা কি করুণ অবস্থায় দিন পার করছে তা লন্ডনভিত্তিক দুটি মানবাধিকার সংগঠনের সাম্প্রতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে। মাইনরিটি রাইট গ্রুপ ইন্টারন্যাশনাল (এমআরজি) ও সেন্টার ফর দ্যা স্টাডি অব সোসাইটি এন্ড সেক্যুলারিজম (সিএসএসএস) প্রকাশিত রিপোর্টগুলো পড়লে বুঝা যায় পরিস্থিতি আসলেই অত্যন্ত গুরুতর।
ভারতে গো-মাংস ভক্ষণ বা জবাইয়ের জন্য গরু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমন সন্দেহে মুসলমাদের পিটিয়ে মারার ঘটনা মহামারি আকার ধারণ করেছে। এই পরিস্থিতি চিন্তাশীল মহলকে যেমন উদ্বিগ্ন করে তুলেছে তেমনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও দেশটির একটি নেতিবাচক রূপ প্রকটভাবে ফুটে উঠছে।
এমআরজি ও সিএসএসএস গত সপ্তাহে একটি যৌথ রিপোর্ট প্রকাশ করে। ‘সংকীর্ণ হয়ে আসছে স্থান: ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য’ শীর্ষক এই রিপোর্টে বলা হয় শুধু ২০১৬ সালেই দেশটিতে সাত শতাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। এতে ৮৬ জন নিহত ও ২,৩২১ জন আহত হয়। এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের বড় অংশ মুসলমান বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ভারতের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কমার কোন লক্ষণ নেই। বার্ষিক হিসাবে দেখা যায় এ সংখ্যা: ২০১১ সালে ৫৮০, ২০১২ সালে ৬৪০, ২০১৩ সালে ৮২৩, ২০১৪ সালে ৩৪৪, ২০১৫ সালে ৭৫১ ও ২০১৬ সালে ৭০৩।
২০১৩ সালে সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ ছিলো বছরের দ্বিতীয়ার্ধে উত্তরপ্রদেশে ছড়িয়ে পড়া উত্তেজনা। পরের বছর সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক প্রচারণা থেকে এই সহিংসতার সূত্রপাত।
উত্তরে উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও মধ্যপ্রদেশ; পশ্চিমে রাজস্তান, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট; এবং দক্ষিণে কর্ণাটক ও কেরালায় সবচেয়ে বেশি দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারতের সংঘটিত ২,৫১২টি দাঙ্গার ৮৫ শতাংশ হয় এসব রাজ্যে।
২০১৬ সালে ৬২টি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এগুলোতে মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাপ্ত উপাত্তে দেখা যায়, চারটি ঘটনায় নিহত ৮ জনের মধ্যে ৭ জনই মুসলমান। একইভাবে পাঁচটি ঘটনায় যেখানে ৪৬ জন মুসলমান আহত হয় সেখানে হিন্দু আহত সংখ্যা ১১। তিনটি ঘটনায় ৬৭টি মুসলিম বাড়ির ওপর হামলার বিপরীতে হিন্দু বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে মাত্র ১টি। এমনকি পুলিশ বেছে বেছে শুধু মুসলমানদেরকেই গ্রেফতার করে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
গোরক্ষা প্রহরীদের উপদ্রব
‘ইন্ডিয়া স্পেন্ডস’ নামের এক ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গো-রক্ষা ইস্যুতে সহিংসতার ৫১% ক্ষেত্রেই মুসলমানরা ছিলো টার্গেট। এমন ৬৩টি ঘটনায় ২৮ জন নিহত হয়, যার ৮৬% মুসলমান।
২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর যেসব হামলার ঘটনা ঘটছে তার ৯৭% হয়েছে মুসলমানদের ওপর। গো-সংশ্লিষ্ট হামলার ঘটনাগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেক (৬৩টির মধ্যে ৩২টি) ঘটেছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে।
২০১৭ সালের প্রথম ৬ মাসে ২০টি ‘গো-সন্ত্রাস’-এর ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। যা ২০১৬ সালে এ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনার ৭৫%। এ ধরনের অর্ধেকের বেশি (৫২%) সন্ত্রাস গুজবের কারণে হয়েছে বলে ইন্ডিয়া স্পেন্ড-এর বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়।
এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর হিসাবে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে উন্মত্ত জনতার হামলায় ১০ জন মুসলমান নিহত হয়।
রাজনৈতিক পরিবেশ
এমআরজি-সিএসএসএস রিপোর্টে বলা হয়, সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে একের পর এক ঘটনা ঘটলেও এগুলোর নিন্দা জানানোর ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি’র ‘অনিহা’ লক্ষ্যনীয়। সরকারের এক মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নাকভী গো-মাংস ভক্ষণকারীদের পাকিস্তান চলে যেতে বলেছেন। কট্টর হিন্দুবাদি এ্যাক্টিভিস্ট সদবি সরস্বতী বলেছেন, যারা গরুর গোস্ত খায় তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলাতে হবে।
গত মে মাসের শেষ দিকে পশুর প্রতি সহিংসতা আইনের দোহাই দিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় হত্যার জন্য বাজারে নিয়ে পশু বিক্রি নিষিদ্ধ করে। এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। এই আইনে বলা হয়, সারাদেশে পশু কেনাবেচার আগে ক্রেতা ও বিক্রেতাকে অঙ্গীকার করতে হবে যে শুধু কৃষিকাজে এগুলো ব্যবহার করা হবে। সমালোচকরা বলছেন, এই আইন আসলে পেছনের দরজা দিয়ে পশু জবাই নিষিদ্ধ করার চেষ্টা। এই আইন মুসলমানদের মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মুসলমানরা গরুর গোস্ত খায় এবং জবাই ও বিক্রি করে। মুসলমানদের ধর্মীয় বিধান পালনের সঙ্গেও পশু জবাই জড়িত।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা ছাড়া বেশিরভাগ রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ। গো-হত্যার জন্য শাস্তির যে বিধান রয়েছে তাও উদ্বেগজনক।
মোদি’র রাজ্য গুজরাটে এই অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ভারতে ‘ধর্মপালনের স্বাধীনতা আইন’টি সাধারণভাবে ধর্মান্তরবিরোধী আইন হিসেবে পরিচিত। ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা হলে এই আইনে খৃষ্টানদের বিচার করা হয় বলে এমআরজি-সিএসএসএস রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
ক্ষমতাসীন বিজেপি সারা দেশের ধর্মান্তর বিরোধী আইনটি প্রয়োগের চেষ্টা করলেও মাত্র সাতটি রাজ্যে এই আইন গ্রহণ করা হয়েছে। রাজ্যগুলো হলো: গুজরাট, অরুনাচল প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, উড়িষ্যা ও ছত্তিশগড়।
এমআরজি-সিএসএসএস রিপোর্টে বলা হয়, এই আইন হিন্দু জাতীয়তাবাদিদের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালাতে উদ্বুদ্ধ করে। এই আইন ব্যক্তির ধর্ম বেছে নেয়ার স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং আইনটি ভারতের সেক্যুলার চরিত্রের জন্যও একটি চ্যালেঞ্জ।
রিপোর্টে বলা হয়, কোথাও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা হলে সেই ঘটনায় মামলা দায়ের থেকে শুরু করে আদালতের রায়ে বিচার পাওয়া অকল্পনীয় দুরহ একটি ব্যাপার।
সাবেক কংগ্রেস সরকার ‘সাম্প্রদায়িক ও লক্ষ্যবস্তু করে সহিংসতা প্রতিরোধ (ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ) আইন করার চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি’র প্রবল বিরোধিতায় এ আইন করা যায়নি।
রিপোর্টে বলা হয়, আইনটি যদি পাস হতো তাহলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো এবং দাঙ্গাকারিদের পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেক কমে যেতো। এতে ক্ষতিগ্রস্তের অধিকার উন্নত হতো। এর ফলে ত্রাণ, পুনর্বাসন ও পুন:প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে সবাই সমান অধিকার পেতো। কিন্তু ২০১৪ সালে মূলত বিজেপি’র বিরোধিতার মুখে এই আইন করার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়।
সহিংসতার নিন্দা জানাতে নেতৃত্বের ব্যর্থতা
লিঞ্চিং বা পিটিয়ে মারা ভারতে নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে উশৃঙ্খল জনতাকে উষ্কে দিয়ে রাষ্ট্র বা রাজ্য সরকারগুলো দেশটিকে ফ্যাসিবাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে দেশটির চিন্তাশীল মহলের একটি অংশ উদ্বিগ্ন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তাদের এই ক্ষোভ বাইরের জগতেও দৃশ্যমান। এরই অংশ হিসেবে দেশটির শহরগুলোতে এখন ‘নট ইন মাই নেম’ বা ‘আমার নামে নয়’ শীর্ষক একটি আন্দোলনের ব্যানার চোখে পড়ে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে এই আন্দোলন। গত দু’বছর ধরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের হত্যকাণ্ডের প্রতিবাদ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটিও বিবৃতি দেননি।
তিনি শুধু বলেছেন, এই কাজ গো-ভক্তদের জন্য শোভনীয় নয়। এমনকি মহাত্মা গান্ধিও এ ধরনের কাজ সমর্থন করতেন না। মোদি আরো বলেন, আইন হাতে তুলে নেয়া কারো উচিত নয়।
এসব কথা বললেও মোদি কোন হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাননি বলে সমালোচকরা অভিযোগ করেন। তিনি শুধু কাজটিকে ‘অনুমোদন করেননি’। তিনি ঘাতকদের সতর্ক করার বা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেননি।
যারা হতাহত হয়েছে তাদের প্রতি সমবেদনাও জানাননি। ক্ষতিগ্রস্তদের বেশিরভাগ গরীব মুসলমান।
ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি কংগ্রেসের সাবেক সদস্য এবং কোন হিন্দুবাদি সংগঠনের সদস্য না হয়েও গত শনিবার পর্যন্ত তিনি নীরব ছিলেন। এরপর একটি বিবৃতি দিলেও তাতে ক্ষোভের বদলে পরিতাপ প্রকাশ পেয়েছে।
নয়াদিল্লি’র এক অনুষ্ঠানে মুখার্জি বলেন, আমরা কি রাষ্ট্রের মৌলিক মতবাদগুলো রক্ষার ক্ষেত্রে পর্যাপ্তরকম সজাগ? এ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এগুলোকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। এ ব্যাপারে ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।
কিন্তু মোদি যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নাগরিকদের সুরক্ষা দানের ব্যাপারে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে প্রেসিডেন্ট মুখার্জিও ব্যর্থ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে ‘পরামর্শ ও সতর্ক’ করার ক্ষেত্রে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে। ভারতের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নেয়ার হাতে গোনা কয়েকদিন আগে একটি বিবৃতি দিয়ে দায় সারতে চেয়েছেন তিনি।
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর
Discussion about this post