মঈন খান
রাজনীতিতে দূর্বৃত্তায়ন কথাটি বলা যায় বেশ কয়েক বছর যাবত প্রচলিত হয়ে গেছে। যদিও দেশে একতরফা একদলীয় শাসনের প্রভাবে সৃষ্ট রাজনৈতিক মন্দায় রাজনীতির সূচক নিম্নমুখী, তবুও মাঝে মধ্যেই থেমে থেমে দূর্বৃত্তায়ন চলছেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ অসহ দূর্বৃত্তায়ন যারা দক্ষতার সাথে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাদের মধ্যে সাবেক স্বৈরশাসক ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অন্যতম।
১৯৮২ থেকে শুরু করে ১৯৯০ পর্যন্ত স্বৈরশাসকের ভূমিকায় থাকলেও এরপর থেকে বিগত ২৭ বছর যাবত বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম এ খলনায়কের দূর্বৃত্তায়ন চলেছে দুর্দান্ত গতিতে। আর এ খল রাজনীতির সাথে ঐতিহ্যগতভাবে বরাবরই আওয়ামী লীগের সখ্যতা লক্ষ্য করা গেছে। অস্বাভাবিক গতিতে বেড়ে ওঠা এই দূর্বৃত্তায়নের ফলে এদেশের রাজনীতি আজ জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনার চেয়ে কুফল বয়ে আনছে বেশি। দেশের মানুষ আজ দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটা শ্রেণী অস্বাভাবিক ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে রাজনৈতিক দানবে পরিণত হয়েছে। আর অপর শ্রেণী সেই দানবের আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে।
রাজনীতির এ সঙ্কটের জন্য যাদের দায়ী করা যায় তাদের মধ্যে ভূঁইফোঁড় রাজনৈতিক দলগুলো অন্যতম। জনসমর্থন শূণ্যের কোটায় থাকার পরেও এসব ভূঁইফোঁড় রাজনৈতিক দলসমূহ মাঝে মধ্যেই রাজনীতির শাখা প্রশাখায় শাখামৃগের মতই বিচরণ করে বেড়ায়। অদ্ভূতরকম সব মেরুকরণের চেষ্টা চালায়। জোটবদ্ধ রাজনীতি সারাবিশ্বে প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশের মত এতগুলো দলের সমষ্টিতে জোট বিশ্বের কোন অনুন্নত দেশেও আছে কিনা আমার জানা নেই। শুনতে অদ্ভূত মনে হলেও এটাই বাস্তব যে, আজকাল আমাদের দেশে অনিবন্ধিত অর্ধশতাধিক দল নিয়েও রাজনৈতিক জোট গঠনের মহড়া চলে। আর সে মহড়ায় নেতৃত্ব দেয় স্বৈরাচার এরশাদ নিজেই। আর তার পার্টির একাংশের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার জানিয়েছেন “শুধু ৫৮ নয়, জাতীয় পার্টির জোটে আরো দল আসবে।” অবশ্য আরো কতগুলো দল যুক্ত করলে জাতীয় পার্টি সরকার গঠন করতে পারবে তা অনুমান করা বেশ কষ্টসাধ্যই বটে। ব্যাপারটা যেন ‘লাখে লাখে সৈন্য চলে কাতারে কাতার/ গনিয়া দেখিল মর্দ চল্লিশ হাজার’। অবশ্য এরশাদের এই জোটে ৫৮ দলের ৫৭ দল একত্র করেও চল্লিশ হাজার হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
রাজনীতিতে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ায় এরশাদ মূলত রাজনৈতিক জোটের বাণিজ্য কিংবা চাষাবাদ শুরু করেছে। প্রমাণ করতে চান যে, তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আসল পুরুষ’। জাতীয় পার্টির এ জোট বাণিজ্য দেখে এক ধূর্ত বানর ব্যবসায়ীর গল্প মনে পড়ে। অনেক দিন আগে এক গ্রামে এক অজ্ঞাত লোক এসে হঠাৎ ঘোষণা দিল সে একেকটা বানর ২০ টাকা দরে কিনবে। সেই গ্রামে ছিল প্রচুর বানরের উপদ্রব। লোকজনও প্রতিদিন বানর ধরে এনে ২০ টাকা দরে লোকটার কাছে বিক্রি করল। গ্রামে যখন বানরের সংখ্যা কিছুটা কমে গেল তখন লোকটা ঘোষণা দিল ৫০ টাকা দরে বানর কিনব। এভাবে চলতে চলতে একদিন গ্রামের সব বানর শেষ হয়ে গেল। সকল বানর এখন অজ্ঞাত লোকটার কাছে। তারপর একদিন সেই অজ্ঞাত লোকটা ঘোষণা দিল একেকটা বানর ৫০০ টাকা দরে কিনবে। গ্রামের লোকজন তো হন্যে হয়ে বানর খুঁজছে। এরই মধ্যে সেই অজ্ঞাত লোকটা একজন মহাসচিব রেখে অন্যত্র চলে গেল। সেই মহা(!)সচিব একদিন কয়েকজন গ্রামবাসীকে ডেকে এনে বলল এই বানরগুলো আপনারা ৪০০ টাকা দিয়ে কিনে নিন। উনি আসলে উনার কাছে ৫০০ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। তাতে আপনাদের ১০০ টাকা লাভ হবে। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ১ দিনের মধ্যে সব বানর বিক্রি হয়ে যায়। তারপর যখন গ্রামবাসী বানর বিক্রি করতে যাবে তখন আর সেই মহা(!)সচিবকেও আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
এরশাদ ও তার মহাসচিবের ঘোষণা অনেকটা ওই শাখামৃগের ধূর্ত ব্যবসায়ীর মতই। যেসব দলের নাম নাই, কেউ চেনে না। দলের প্রধান কে তার নামই জানে না। কদাচিৎ দলের প্রধানের নাম জানলেও দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড কে তা জানার প্রশ্নই ওঠে না। এমন দল যাদের ভূঁইফোঁড় বলতেও লজ্জা লাগে। সেসব রাজনৈতিক শাখামৃগদের একত্রিত করে এরশাদ মূলত রাজনীতির ময়দানে নিজের অবস্থান জানান দিতে চান। অবশ্য এই জোট গঠনের পূর্বে এরশাদ অনির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন অবৈধ এ সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা সরে আসবেন তাদের পদ থেকে। এসব পদত্যাগের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি ‘আসল বিরোধী দলে’র মর্যাদা ছিনিয়ে আনবে বলে অনেকে ধারণাও করেছিল। কিন্তু বরাবরের মতই সকলকে অবাক করে দিয়ে ‘বিশেষ দূত’ এবং তার দলের অনির্বাচিত মন্ত্রীরা স্ব স্ব পদে বহাল রয়েছেন। দেখা যাক রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়নের এ খেলা কতদিন চলে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
Discussion about this post