ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সে দেশের সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা একটি মামলায় ‘আদালতের বন্ধু’ হতে চেয়ে ভারতকে চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন।
ভারত অবশ্য দাবি করছে নাগরিকত্ব আইন পুরোপুরি তাদের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ এবং জাতিসংঘের ওই সংস্থার কোনও এক্তিয়ার নেই ওই আইনি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার।
কিন্তু ভারতেই বহু বিরোধী রাজনীতিবিদ মনে করছেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তি যে কতটা তলানিতে ঠেকেছে কমিশনের এই পদক্ষেপ তারই প্রমাণ।
ভারতের আইন বিশেষজ্ঞরাও অনেকেই বলছেন জাতিসংঘের ওই সংস্থার চাওয়াতে কোনও আইনগত বাধা নেই।
বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট পিটিশন করেছিলেন সাবেক কূটনীতিবিদ ও ঢাকায় ভারতের প্রাক্তন হাই কমিশনার দেব মুখার্জি।
কিন্তু ‘দেব মুখার্জি ও অন্যান্যরা বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’-র সেই মামলায় ‘অ্যামিকাস কিউরি’ হিসেবে হস্তক্ষেপ করতে চেয়ে পরিস্থিতিতে নাটকীয় মোড় এনে দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনারের কার্যালয়।
বর্তমান হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলে, যিনি আগে চিলির প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তার কার্যালয়ের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তের কথা জেনিভায় ভারতীয় দূতাবাসকে ইতিমধ্যে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও বর্তমানে ভারতের কংগ্রেস এমপি শশী থারুর কিন্তু এতে এতটুকুও বিস্মিত নন, কারণ তার মতে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের ভাবমূর্তি কখনওই আগে এতটা খারাপ ছিল না।
তাঁর কথায়, “গত ছমাস ধরে দুনিয়ার সর্বত্র ভারতকে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা চলছে, এমন কী যে সব দেশ ভারতের প্রতি চিরকাল বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল তারাও বিগড়ে যাচ্ছে।”
“উঁচু সরকারি পদে থাকা আমার বিদেশি বন্ধুরা এমনও বলছেন, আমরা ভারতের সঙ্গে মিত্রতাই চাই – কিন্তু আপনাদের সরকারকে দয়া করে বলুন আমাদের সেই কাজটা এত কঠিন করে তুলবেন না।”
“আর এটা বেশি করে শুনতে পাচ্ছি ইসলামী দেশগুলোর কাছ থেকে।”
“এই পটভূমিতে জাতিসংঘের ওই সংস্থার বিরল পদক্ষেপটা এটাই দেখিয়ে দিচ্ছে যে দুনিয়ার চোখে ভারতের মর্যাদা কোন তলানিতে এসে ঠেকেছে – আর সেটা অতীব দু:খের!”, বলছিলেন মি থারুর।
জাতিসংঘের ওই সংস্থার সিদ্ধান্ত জানার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতি দিয়ে দাবি করে, নাগরিকত্ব আইন সম্পূর্ণত ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
মুখপাত্র রবীশ কুমারের স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইউএনএইচআরসি-র কোনও এক্তিয়ার বা ‘লোকাস স্ট্যান্ডাই’-ই নেই এই বিষয়ে নাক গলানোর।
হায়দ্রাবাদের নালসার ইউনিভার্সিটি অব ল-র উপাচার্য ড: ফায়জান মুস্তাফা অবশ্য এই দাবির সঙ্গে মোটেই একমত নন।
তার কথায়, “একটা মানবাধিকারের প্রশ্নে জাতিসংঘের ওই সংস্থার লোকাস স্ট্যান্ডাই কী, এটা বলাটাই আমার মতে চূড়ান্ত হাস্যকর।”
“মনে রাখতে হবে এটা একটা জনস্বার্থ মামলা, এখানে কখনও আবেদনকারীকে জিজ্ঞেস করা হয় না তোমার লোকাস স্ট্যান্ডাই কী?”
“জনস্বার্থ মামলা ব্যাপারটা চালু হওয়ার আগে আদালত পিটিশনার-কে জিজ্ঞেস করতে পারত তোমার কোন অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে? কিন্তু জনস্বার্থ মামলায় এখন একমাত্র প্রশ্ন হল, কার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে?”, জানাচ্ছেন ড: মুস্তাফা।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ দর্শনা মিত্রও বিবিসিকে বলছিলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনারের কার্যালয় যে ইন্টারভেনশন অ্যাপ্লিকেশন বা হস্তক্ষেপের আবেদন করেছে, সেটা করার আইনগত অধিকার তাদের অবশ্যই আছে।
মিস মিত্র বলছিলেন, “অ্যামিকাস কিউরি কথাটার আক্ষরিক অর্থ হল আদালতের বন্ধু। এখন কোর্ট চাইলে এই অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে যে কোনও লোক বা সংস্থাকেই নিয়োগ করা যেতে পারে।
“হ্যাঁ এটা ঠিকই যে সচরাচর জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে কাউকে এনে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ করার নজির বিশেষ একটা নেই। কিন্তু তাই বলে এটা করার ক্ষেত্রে কোনও বাধা-ও নেই।”
“অনায়াসে তারা এই ধরনের কোনও আবেদন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে করতে পারেন, সেখানে আইনগতভাবে আপত্তি তোলার কোনও সুযোগ নেই।”
“আর তাদের মূল কাজটা হল আদালত যেভাবে বলবেন, সেভাবে তারা ওই মামলা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হয়তো কোনও প্রতিবেদন বা ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্ট দিলেন, তথ্য জোগালেন।”
“ভারতেও এনআরসি-সংক্রান্ত একটি মামলায় অ্যক্টিভিস্ট হর্ষ মান্দেরকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আসামের ফরেনার্স ডিটেনশন সেন্টারগুলো ঘুরে দেখে পরিস্থিতি রিপোর্ট করার।”
“তিনি সরেজমিনে ঘুরে দেখে তা করেওছিলেন, যদিও পরে তাকে ওই ভূমিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।”
“এখানেও অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে জাতিসংঘের সংস্থাকে গ্রহণ করা হবে কি না, বা হলেও তাদের কী ভূমিকা হবে – সেটার পুরোটাই ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ওপর নির্ভর করছে”, জানাচ্ছেন দর্শনা মিত্র।
জাতিসংঘের সংস্থার পদক্ষেপ ভারতের জনমতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, সেটা ভেবে অবশ্য মূল মামলাকারী দেব মুখার্জি হাই কমিশনার মিশেল ব্যাচেলের সিদ্ধান্তে খুব একটা ‘স্বস্তি বোধ’ করছেন না।
কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের বিরুদ্ধে এত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যে অতীতে কখনও ওঠেনি, গোটা ঘটনায় সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সূত্র: বিবিসি