– হাসান রূহী
আজ একটু অন্যভাবে কলম ধরেছি। বলতে পারেন ফুরফুরে মেজাজে। এছাড়া অবশ্য কিছু করারও নেই। চারদিকে এত এত কৌতুকপূর্ণ লুটপাটের ঘটনা ঘটছে যে, ব্যাথা বুকে নিয়েও প্রচন্ড বেগে হাসতে হচ্ছে। একেক ঘটনা দেখে মনে পড়ছে একেক রকম কৌতুক। ভাবলাম সেগুলো আপনাদের সাথেও ভাগাভাগি করা যাক। তাতে যদি আপনারাও কিছুটা ব্যাথা বুকে নিয়ে অট্টহাসি দিতে পারেন!
| এক |
ক্যাসিনো কান্ড শুরু হওয়ার পর একদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কথায় কথায় এক বন্ধু বলে উঠলো- জানিস এখন তো আমরা বিটিভি ভারতেও সম্প্রচার করছি। কথাটা বলতেই হাসির রোল পড়ে গেল। এক রসিক বন্ধু হাসতে হাসতেই বললো- যাক বাবা! এইবার অন্তত প্রথমবারের মত আমরা কোনো অচল জিনিস ভারতে চালিয়ে দিতে পারলাম। কথা শেষ না হতেই যেন অন্যরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কিন্তু ওদের ওসব হাস্যরসে গা না মাখিয়ে তখন আমি যুবলীগ নেতা সম্রাট ওরফে ক্যাসিনো সম্রাটকে নিয়ে যুগান্তরের একটা রিপোর্ট পড়ছিলাম। এতে বন্ধুরা বেশ বাধ সাধলো। একজন আমাকে অন্য কিছুটা অন্য মনস্ক ও চিন্তিত দেখে জিজ্ঞাসা করলো- এই তুই কোনোদিন বিটিভি দেখিস? আমি বললাম- অবশ্যই দেখি। বিটিভি না দেখলে দেশের মানুষ এত সুখে শান্তিতে আছে তা জানবো কি করে?
কথা শেষ না করতে আবারও হাসির রোল পড়ে গেল। একজন পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো- তুই ব্যাটা আসলেই একটা ক্যাসিনো লীগ। আমি বললাম এটা আবার কি! নতুন দল হইছে নাকি? আরেকজন বললো হতে আর কতক্ষণ? সরকারের ইঙ্গিতে উচ্চ আদালত দয়াল বাবা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে বাঁচানোর তাগিদে ক্যাসিনো পুরোপুরি জায়েজ করে দিলেই তো এই নামে একটা সংগঠন দাঁড় করিয়ে ফেলা যায়।
আমি ওদের থামিয়ে এবার সিরিয়াস কথা শুরু করলাম। বললাম তোরা যে এত বিটিভি নিয়ে মাতামাতি করিস, বাতাবি লেবু বলিস, দেশের অন্যান্য টিভি চ্যানেলগুলোকে তো তা বলিস না। অন্যান্য টিভি চ্যানেলগুলো বিটিভির চেয়ে কোন দিক দিয়ে ভালো? দেশের সব টিভিই তো এখন ডিজিটাল বাকশালের নরম ছোঁয়ায় বিটিভি বনে গেছে। ক্ষমতাসীন সরকার যেদিকে ইঙ্গিত করে মিডিয়াগুলো অভূক্ত সারমেয়দের মত সেদিকে কুঁই কুঁই করে ছোটে।
এই যে তোর আমার ঘরের কোনে এত এত ক্যাসিনো গড়ে উঠেছে, তা কি আমাদের মিডিয়াগুলো এর আগে কোনোদিন তুলে ধরেছে? এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? কোনো কথা বলেছে এতদিন? নাকি এগুলো মাত্র গতকালকেই গড়ে উঠেছে? অথচ যেই মাত্র দখলদার সরকার নিজেদের ইমেজ উদ্ধারের মানসে মিডিয়াকে ইঙ্গিত দিয়েছে অমনি সরাসরি ক্যাসিনো থেকে লাইভ সম্প্রচার শুরু হয়ে গেল। একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দিন-রাত প্রচার হতে শুরু করলো। এখন দেশের সব টিভিই বিটিভি। বন্ধুরা সায় দিল আমার কথায়। সেদিনের আড্ডা হাস্যরসে শুরু হলেও শেষ হলো অনেক গভীর চিন্তা মাথায় নিয়ে। সে চিন্তা দেশের চিন্তা, দশের চিন্তা।
| দুই |
অফিসে গিয়ে কাজের বিরতিতে আবারও কথা উঠলো ক্যাসিনো নিয়ে। একজন খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো- ভাই, এদিক সেদিক দিয়ে কয়েকজন গ্রেফতার হলো। তারপর আর কোনো গ্রেফতারের খবর নাই। এমনকি সব দিক থেকে যে লোকটির দিকে আঙ্গুল উঠলো সেই ক্যাসিনো সম্রাটই তো গ্রেফতার হলো না। বিষয়টা কেমন হয়ে গেল না? আমি বললাম ভাই। ওসব উপরওয়ালাদের ব্যাপার কেন শুনতে চাও বলো তো? ভাইটি অনেকটা অসহায় ভঙ্গিতে দাঁত কেলিয়ে বললো- কি যে বলেন ভাই? আমরা কি দেশের জনগণ না? আমরা কি দেশের খবর রাখতে পারি না? আমি বললাম তোমরা তাহলে নিজেদের দেশের জনগণ মনে করতে শুরু করেছো? র্যাবকে খবর দিব না পুলিশকে বলো তো? মানে আমি বুঝাতে চাচ্ছি কার হাতে গুম হতে তুমি স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করবে? লোকটা ভয়ে চুপসে গেল একদমই। আমি এবার মুচকি হাসলাম। লোকটাকে অভয় দিয়ে বললাম আমরা কেমন জনগণ জানো? বলল না। আমি বললাম শোনো তাহলে তোমাকে একটা গল্প শোনাই।
এক সিংহ আহত হয়ে রাস্তার উপর অনেকটা আড়াআড়ি হয়ে পড়ে আছে। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক খরগোশ। অত্যন্ত বিনয় প্রকাশ করে হাত জোর করে বললো- হুজুর আপনি রাস্তার মাঝখানে এভাবে পড়ে আছেন যে! আজ তো বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডা লেগে যাবে তো হুজুর।
সিংহ কাতর কণ্ঠে বললো- শুয়ে আছি কি সাধে রে, গুলি খেয়েছি।
খরগোশ এবার গলা মোটা করে চোখ লাল করে বললো- হারামজাদা! গুলি খেয়েছিস ভালো কথা। তাই বলে কি গোটা পথ জুড়ে শুয়ে থাকতে হবে?
আমরা যারা দেশের জনগণ বলে দাবি করি তাদের অবস্থা ওই খরগোশের মতই। ক্যাসিনো সম্রাটরা যখন তাদের সাঙ্গ পাঙ্গ সাথে নিয়ে চোখ রাঙিয়ে আমাদের ভোট ডাকাতি করে নিয়ে যায়, ফুটপাথের দরিদ্র দোকানী থেকে শুরু করে বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা তুলে নিয়ে জুয়ার আসর বসায়। সে আসরের লব্ধ একটা অংশ ক্ষমতাসীন দলের ফান্ডে গিয়ে জমা হয়। আরেকটি অংশ দলীয় প্রভাবশালী নেতাদের পকেটে যায়, তখন আমাদের কিছুই করার থাকে না। নীরব দর্শক হয়ে আমরা তা দেখতেই বরং পছন্দ করি। কিন্তু এই নবাবজাদারা যখন ফাঁদে পড়ে যায় তখন আমরাই তাদের হারামজাদা বলি। কখন তাদের নিয়ে কি নাটক তৈরী হচ্ছে তা মঞ্চস্থ হওয়ার অপেক্ষায় টিভির সামনে আর পত্রিকার পাতায় গোগ্রাসে বসে থাকি। সামাজিক মাধ্যমে নিন্দার ঝড় তুলি। নতুন প্রজন্ম তাদের নিয়ে ট্রল, মেমে আর রম্য ভিডিও বানিয়ে মনে করে মোটামুটি একটা মুক্তিযুদ্ধ করে ফেলেছে!
ধরুন, রূপপুর থেকে ফরিদপুর হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল। বালিশ, বালিশের কভার, বিছানার চাদর, জানালার পর্দা থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক চুলা কিংবা কেটলি। কে কোনটা কত বেশি দামে কিনতে পারে তার যেন একটা প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কি? জনগণ তাকিয়ে আছে ওবায়দুল কাদের কি বলে তার দিকে। তিনি অবশ্য এরই মধ্যে অনলাইনে দৃঢ় অবস্থান নেয়া সচেতন জনগণের উদ্দেশ্যে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এটা ‘ছিঁচকে কাজ’। তিনি বলেছেন – ‘এটা হওয়া ভবনের মতো লুটপাটের বিষয় নয়। দেশটাকে লুটপাট করে খেয়েছে হওয়া ভবন। এটা আমি দাবির সঙ্গে বলতে পারি। বালিশ আর পর্দার সঙ্গে হাওয়া ভবনকে মেলানো যাবে না।’ জনগণ কেউ কেউ হয়তো ওবায়দুল কাদেরের এই বার্তা উপরোল্লিখিত খরগোশের মত বিনয়ের সাথে মেনে নিয়েছে। আর কেউ কেউ বিভিন্নভাবে নিন্দার ঝড় সৃষ্টি করে কাঁপিয়ে তুলেছেন সামাজিক মাধ্যম।
সামাজিক মাধ্যমে যারা নিন্দার ঝড় তোলেন তাদের অবস্থাটাও অনেকটা ভার্চুয়াল জগতের মতই। তাদের প্রতিবাদের ধরণ দেখলে তাদের জনগণ নয়, সর্বোচ্চ দেশের ভার্চুয়াল জনগণের মর্যাদা দেয়া যেতে পারে। আপনাদের মনে কষ্ট দেয়ার কোনো উদ্দেশ্যই আমার নেই। কেউ যদি নিজেদের জনগণ মনে না করে ভার্চুয়াল জনগণ থাকাতেই সুখ অনুভব করেন, তাতে আমি আপত্তি করার কে! আমি শুধুমাত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি।
পথের পাশে এক থুত্থুরে বুড়ো ঘোড়ার পাশে এসে বসলো কাক। ঘোড়া দুর্বল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো – ওহে কাক, তোর কিছু দরকার আছে আমার কাছে?
কাক রাগত স্বরে বললো- তুই কবে মরবি তাই বল।
থুত্থুরে ঘোড়া জবাবে বললো – মঙ্গলবারের আগে মরছি না।
কাক বললো- তাতে কী! আমি অপেক্ষা করবো। শুক্রবার পর্যন্ত কোনো কাজই নেই আমার।
একসময়ে রাষ্ট্রীয় অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণ যেভাবে রাজপথে প্রতিবাদের ঝড় তুলতো, এখন সে ঝড় বয়ে যায় অনলাইনে। হাড্ডিখোর সারমেয়র ভূমিকায় থাকা গণমাধ্যমগুলোও তখন সামাজিক মাধ্যমে বয়ে যাওয়া ঝড়ের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রচার করে আত্মতুষ্টিতে ভোগে। আশির দশকের ছাত্রনেতা বলতে একদল হিরোকে বুঝানো হয়। যারা স্বৈরাচার এরশাদের দুর্নীতি, অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করে রাজপথে অবস্থান নিয়ে ক্ষমতার মসনদ থেকে তাকে চিরতরে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজকের প্রজন্ম দিয়ে কি তা আদৌ সম্ভব? বিতর্কের জন্য নয়। কথাগুলো বলছি চিন্তা করার জন্য। মঙ্গলবারে শেষ বিদায়ের আগ্রহ প্রকাশ করা ঘোড়ার পাশে শুক্রবার পর্যন্ত অপেক্ষার আগ্রহ প্রকাশকারী কাকের মত যেন আমাদের তরুণ প্রজন্ম অপেক্ষা করতে চায়। ততক্ষণে দেশে যতই দুর্নীতি, অনিয়ম আর জনগণের সম্পদ লুটের ঘটনা ঘটুক। এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে…!
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট