গণশুনানি অনুষ্ঠানের সভাপতি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত দাবি। নির্বাচন নিয়ে গণশুনানি হলেও এখান থেকে খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি যাওয়া উচিত।
আজ শুক্রবার সকালে রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত গণশুনানি শেষে সমাপনী বক্তব্যে ড. কামাল এ কথা বলেন। দিনব্যাপী গণশুনানিতে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেওয়া ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা নানা অভিযোগ তুলে ধরেন।
প্রার্থীরা বলেন, সাত দফা দাবি না মানার পরও নির্বাচনে অংশ নিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। তফসিলের পর দেশজুড়ে মামলা, গ্রেপ্তার, হামলা অব্যাহত থাকলেও কঠোর কোনো প্রতিবাদ করেননি কেন্দ্রীয় নেতারা। নির্বাচন কমিশনকে চাপে ফেলতে দেওয়া হয়নি কোনো কর্মসূচি। এমনকি ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করা হলেও আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে না। এক বছর ধরে দলের সভানেত্রী খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলেও তাঁর মুক্তির দাবিতে কিছু করছে না ঐক্যফ্রন্ট। তাই আর দেরি না করে দ্রুত মাঠের আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার দাবি জানান তাঁরা।
চট্টগ্রাম-৯ আসনের শাহাদাত হোসেন বলেন, এত হামলা-মামলার পরও ইসিতে তেমন কোনো প্রতিবাদ করা হলো না কেন! তিনি নিজেও ভোটের আগে গ্রেপ্তার হয়ে গত ৩০ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান।
কুমিল্লা-১০ আসনের মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, ৭০–এর নির্বাচনের মতো এবার ধানের শীষের পক্ষে সমর্থন ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা তা কাজে লাগাতে পারেননি। আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা ছাড়া কোনো বিকল্প দেখেন না তিনি।
পরে কামাল হোসেন বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত দাবি। নির্বাচন নিয়ে গণশুনানি হলেও এখানে সবার বক্তব্যে এ দাবি এসেছে। তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি এ অনুষ্ঠান থেকেও যাওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, ‘জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে স্বাধীনতার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে বলা যায়, আমরা দেশকে পুনরুদ্ধার করেছি।’
দলের সমালোচনায় উত্তেজনা
সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত চলে প্রথম সেশন। নামাজ ও খাবারের বিরতির পর দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়। সময় কম থাকায় মঞ্চ থেকে বক্তাদের দ্রুত কথা শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ বক্তা তখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও আন্দোলন নিয়ে উত্তেজিত বক্তব্য দিচ্ছিলেন। উপস্থিত নেতা-কর্মীদের সমর্থন পান তাঁরা। হল সরগরম হয়ে ওঠে। আরও প্রার্থী কথা বলার জন্য আগ্রহ দেখাতে থাকেন। সময় স্বল্পতার জন্য তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। চারটায় শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত চলে গণশুনানির অনুষ্ঠান। নির্বাচন বাদ দিয়ে অনেক নেতা দলের সমালোচনা করতে থাকেন। মঞ্চ থেকে কয়েকবার শুধু নির্বাচন নিয়ে কথা বলার নির্দেশনা দিলেও তাতে কাজ হয়নি।
নোয়াখালী-২ আসনের জয়নাল আবেদীন ফারুক বলেন, ২৭ ডিসেম্বর ইসির সামনে ৩০০ প্রার্থীর বসে যেতে মওদুদ আহমদের দেওয়া পরামর্শ বিবেচনা করতে পারতেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেন, ‘নেত্রীর মুক্তির দাবিতে কেন কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে না, আর সহ্য হচ্ছে না মহাসচিব।’ দলের শুনানি প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। পিরোজপুর-৩ আসনের রুহুল আমিন বলেন, ‘নেতৃবৃন্দের আচরণ পছন্দ হয় না, সমন্বয়ের অভাব। এত ভয় পাইলে হবে না। ঘরের মধ্যে অনুষ্ঠান না করে বাইরে বের হতে হবে।’
একপর্যায়ে মঞ্চ থেকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আত্মসমালোচনার জন্য গণশুনানি নয়। অনুরোধ করার পরও অনেকে শুনছেন না। এটা দলীয় ফোরামে করলে ভালো হতো।’ ওই সময়ে মঞ্চের সামনের সারি থেকে কয়েকজন প্রার্থী বলে ওঠেন, ‘দলের ফোরামে তো আলোচনা হচ্ছে না। এখানে এ আলোচনাও চলবে।’
৪১ প্রার্থীর অভিযোগ
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ‘অনিয়ম’ নিয়ে আয়োজিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গণশুনানিতে বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন ৪১ জন প্রার্থী। প্রচারে বাধা দেওয়া, গায়েবি মামলা, নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের অভিযোগ করেছেন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার প্রার্থী। সবার বক্তব্যে ভোটের আগের রাতে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষে সিল মারার অভিযোগ এসেছে। এজেন্ট ঢুকতে না দেওয়া, কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগও করেছেন সবাই।
লালমনিরহাট-৩ আসনের আসাদুল হাবিব বলেন, তফসিলের পর এক মামলায় ৪১৯ জনকে আসামি করে সবাইকে এলাকাছাড়া করেছে। তাঁর এলাকায় ৭ কেন্দ্রে শতভাগ ও ২৩ কেন্দ্রে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের রোমানা মাহমুদ তাঁর ওপর হামলার অভিজ্ঞতা বলেন। তাঁর সঙ্গে আসা এক নারী কর্মী মেরী বেগম বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারে সরকারি দলের হামলায় দুই চোখ হারিয়েছি। চোখ হারিয়ে অতটা কষ্ট পাইনি, যতটা কষ্ট পেয়েছি কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পেরে।’ রাজশাহী-২ আসনের মিজানুর রহমান বলেন, আগের রাতে পৌনে নয়টা থেকে দুইটা পর্যন্ত ১৩৩ কেন্দ্রে সিল মারা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর গুলির ভয়ে সবগুলো কেন্দ্র পাহারা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
যশোর-৩ আসনের অনিন্দ্য ইসলাম বলেন, ১৩ মামলায় এক হাজারের বেশি আসামি করা হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বরের পর কোনো কর্মী তাঁর সঙ্গে থাকতে পারেননি। ৫৮ কেন্দ্রে আগের রাতে ভোট হয়েছে। কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে জেএসডির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, এক পরিবারের ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নরসিংদী-১ আসনের খায়রুল কবির খোকন বলেন, ৯টি গায়েবি মামলায় ৫ হাজারের বেশি আসামি করা হয়। জামিন নিতে গেলে তাঁকেও কারাগারে পাঠানো হয়। কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের ফজলুর রহমান বলেন, ২৪ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পুলিশ তাঁকে বাসায় বন্দী করে রাখে। নিজের ভোট দিতেও বের হতে পারেননি তিনি।
পাবনা-১ আসনের গণফোরামের প্রার্থী আবু সাইয়ীদ অভিযোগ করেন, ৮ বার হামলা হয়েছে তাঁর ওপর, তাঁর চারটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তাঁর বহরে ৬৬টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাইফুল ইসলাম ফিরোজ দাবি করেন, তাঁর এলাকার একটি কেন্দ্রে মোট ভোটের মধ্যে মাত্র ১১ ভোট কম পড়েছে, অথচ সেখানে মৃত ভোটারের সংখ্যা ২৫।
নির্বাচন প্রসঙ্গে ড. কামাল বলেন, শুনানিতে দেওয়া সবার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, অবাধ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে একই কৌশল সারা দেশে নেওয়া হয়েছে। এটাকে নির্বাচন বলা যায় না, এটা প্রহসন। এর মধ্য দিয়ে সংবিধান অবমাননা করা হয়েছে।
গণশুনানি থেকে গণ–আদালত
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ছাড়া মঞ্চে বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে প্যানেলে ছিলেন এমাজউদ্দীন আহমদ, নুরুল আমিন বেপারী, মহসিন রশীদ, আনিসুর রহমান খান, দিলারা চৌধুরী ও আসিফ নজরুল। তাঁরা কেউ কোনো বক্তব্য দেননি। প্রার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ গণশুনানি গণ–আদালতে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানান ঐক্যফ্রন্টের কাছে। প্রার্থীদের কয়েকজন এই গণশুনানিকে গণ–আদালতে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানান। লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের শহীদ উদ্দিন চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বলেন, গণ–আদালতের মাধ্যমে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তবে গণশুনানির শুরুতে কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা ঠিক বিচারক নই, বিচার হচ্ছে ট্রাইব্যুনালে। আমাদের বিচার করার ক্ষমতা নেই, দায়িত্বও না। রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে জনগণের কাছে সঠিক চিত্র তুলে ধরতেই এ শুনানি। আর এটা ঠিকভাবে পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞদের প্যানেল।’
অগ্নিকাণ্ড নিয়ে শোকপ্রস্তাব
চকবাজারের আগুনে নিহত লোকজনের জন্য শোক প্রস্তাব করেন ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। এরপর নিহত লোকজনের উদ্দেশে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় যা ইচ্ছা তা-ই করছে সরকার। তাকে কোনো কিছুর জন্য জবাবদিহি করতে হয় না।’
গণশুনানিতে আরও উপস্থিত ছিলেন জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান প্রমুখ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০–দলীয় জোটের মধ্যে লেবার পার্টির এক প্রার্থী বক্তব্য দিলেও বাকি শরিকদের কাউকে দেখা যায়নি।
সূত্র: প্রথম আলো