মাসুম খলিলী
পাকিস্তানের নির্বাচনে নতুন শক্তি ক্ষমতায় যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। দেশটিতে বিশেষ জনপ্রিয়তার পরও কেন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নেওয়াজ শরীফকে বিদায় নিতে হলো, কেনইবা ১০ বছরের কারাদন্ড ভোগ করতে তাকে কন্যাসহ জেলে যেতে হলো- এ এক বিরাট প্রশ্ন। এক সময় নওয়াজের দল মুসলিম লীগ অনেক ব্যবধানে জিতবে বলে ধারণা করা হলেও এখন কেন দলের সমর্থন বা জেতার সম্ভাবনা ক্রমেই নিম্নগামি হচ্ছে এই প্রশ্ন অনেকের। কিছুদিন আগেও প্রধান দু’দল মুসলিম লীগ নওয়াজ এবং ইমরান খানের পিটিআই মুখোমুখি অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছিল। সাম্প্রতিকতম জরিপে দেখা যাচ্ছে পিটিআইএর সমর্থন যেখানে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে মুসলিম লীগ নওয়াজের সমর্থন ধীর গতিতে নিচের দিকে যাচ্ছে। এর মধ্যে লন্ডনে ক্যান্সারাক্রান্ত স্ত্রীকে রেখে পাকিস্তানে ফিরেছেন নওয়াজ ও তার কন্যা মরিয়ম নওয়াজ। দুই জনকেই বিমান বন্দর থেকে আদালতের দন্ডাদেশ ভোগ করার জন্য কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দলের ধারণা ছিল নওয়াজের এই ত্যাগের প্রভাব পড়বে নির্বাচনী ফলাফলে। নির্বাচনের আগে তারা মুক্তি লাভ অথবা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু যে সহানুভুতি ভোট পাবার আশা দলের ছিল সেটিও দেখা যাচ্ছে না।
সাধারণভাবে বলা হচ্ছে ডিপ স্টেটের (সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থা) সাথে দ্বন্দ্বের কারণে নওয়াজের রাজনৈতিক কেরিয়ার ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কেন ডিপ স্টেট হিসাবে বর্ণিত বিচার বিভাগ এবং সেনা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান নওয়াজের বিপক্ষে চলে গেলো? নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুতকারী জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সময় সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরির নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন নওয়াজ শরীফকে রাজনৈতিকভাবে পূনর্বাসনে সহায়তা করেছিল। সেবার জারদারির নেতৃত্বে পিপিপি ক্ষমতায় গেলেও সেটি হয়েছিল বেনজির ভুেট্টার হত্যাকান্ডে সহানুভুতির জোয়ারে। পরের বার নওয়াজ বিপুল সংখ্যাধিক্যে ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে, ভিন্ন চিত্র। মুসলিম লীগের প্রভাবশালী এমপিদের অনেকেই দল বেধে পিটিআইতে যোগ দিয়েছেন। অনেকেই দল ত্যাগ করে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে ভবিষ্যতে কোয়লিশন সরকারের অংশীদার হবার পথ প্রশস্ত করেছেন। এতে স্পষ্ট যে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের সাথে নওয়াজ মুসলিম লীগের সুতার বাঁধন ছিড়ে গেছে।
তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই যে পরিবর্তন তার পেছনে অনেক গভীর কারণ সম্পৃক্ত বলে মনে করা হচ্ছে। পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবার উপরে স্থান দেয়া হয়। ১৯৭১ সালে দেশটির পূর্বাংশ রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হবার পর এ বিষয়ে সংবেদনশীলতা আরো বেড়ে গেছে। এই বিপর্যয়ের জন্য ইয়াহিয়া খানের অপরিণামদর্শি সামরিক নেতৃত্ব দশ্যত দায়ী বলে মনে হলেও এর গভীর অনুসন্ধানে এর পেছনে রাজনীতিবিদদের যোগসূত্র পাওয়া যায়। যার সাথে সংযুক্তি পাওয়া যায় প্রতিবেশি দেশটিরও। এ কারণে রাজনীতিবিদরা যতটা সহজভাবে প্রতিবেশি দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রসর হতে চান ততটা সহজে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীরা এগুতে চান না। আর চূড়ান্তভাবে জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে পাকিস্তানীদের আস্থা সশস্ত্র বাহিনীর উপরই দেখা যায়।
স্বল্প অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জারদারি ক্ষমতায় যাবার পর প্রথমে বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেনি। তিনি কাশ্মীরের সংগ্রাম এবং ভারতের সাথে সম্পর্ক নিয়ে এমন কথা বলে ফেলেন যাতে ডিপ স্টেট থেকে তাকে সতর্ক করা হয়। এরপর নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে জারদারি নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যাননি। তিনি পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে বিদায় নিয়েছেন। বিদায়ের পর এখনো জেলে যাবার মতো পরিস্থিতির মুখে তিনি পড়েননি। যদিও এক সময় জারদারির পরিচিতিই তৈরি হয়েছিল মিস্টার টেন পারসেন্ট হিসাবে।
কিন্তু নওয়াজের কেন ভিন্ন অবস্থা। আগের দু’বার না হয় বুঝতে না পেরে সেনা প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। কিন্তু এবার কেন? আসলে নওয়াজ নিজের জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাব দিয়ে সব কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। মোদির সাথে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যার ডকট্রিনই হলো পাকিস্তানের মানচিত্র পারলে মুছে দেয়া। মোদির ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের সাথে নওয়াজ গড়ে তুলেছেন ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়িক সম্পর্ক। শেষ পর্যন্ত এর মূল্য দিতে হচ্ছে তাকে। এই মূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বিচার বিভাগ ও সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে নামার কারণে। এমন বক্তব্য দেয়ায় যাতে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে সন্তাসের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে এটিকে যুক্তি হিসাবে হাজির করা যায়।
নওয়াজের কথা ও ইচ্ছানুযায়ী বিচার বিভাগ ও সেনা বাহিনী রাজনীতিবিদদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে পাকিস্তানের কার্যকর অস্থিত্ব কতদিন থাকবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সেদেশের অনেকেরই। রাজনীতির জন্য যারা নওয়াজকে সমর্থন করেন তাদের অনেকেই নিরাপত্তার জন্য তার উপর আস্থা রাখেন না। সম্পদ ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা এক সময় বাস্তবতা বুঝে চলার পরিণামদর্শিতাকে বিদায় করে দেয়। নওয়াজের ক্ষেত্রে সম্ভবত তাই হয়েছে। তিনি এখন নিজে ডুবতে বসেছেন, সাথে বেধে নিয়েছেন দলকেও।
দেশটির ইংরেজি দৈনিক ডন নির্বাচনের প্রাক্কালে একটি গুরুত্বপূর্ণ জরিপ করেছে। নির্বাচনের দলগত অবস্থানের জন্য যেমন এই জরিপের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে তেমনিভাবে এই নির্বাচনে কোন শক্তি কতটা প্রভাব বিস্তার করে তারও একটি চিত্র ফুটে উঠেছে এতে। দেখা গেছে, তরুণ ভোটাররা পিটিআইয়ের প্রতিই এখন বেশি ঝুঁকে পড়েছে। তাদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ পিটিআই এবং ২৪ শতাংশ নওয়াজ মুসলিম লীগকে সমর্থন করার কথা জানিয়েছে। আরেকটি তাত্পর্যপূর্ণ প্রবণতা দেখা গেছে ২০১৩ সালে যারা যে দলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন তাদের সমর্থনের সম্ভব্য পরিবর্তন। পিটিআইয়ের সমর্থকদের মধ্যে সাড়ে ১৪ শতাংশ এবার অন্য দলকে ভোট দেবেন। এর মধ্যে মুসলিম লীগকে ভোট দেবেন সাড়ে ৯ শতাংশের মতো। কিন্তু নওয়াজ মুসলিম লীগের পক্ষে গত বার যারা ভোট দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে সাড়ে ৩৫ শতাংশ এবার আর এ দলের পক্ষে ভোট দেবেন না। সুইং করা এই ভোটারদের মধ্যে ৩২ শতাংশই এবার পিটিআইকে ভোট দেবেন।
ইতিমধ্যে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে পিটিআই এবারের নির্বাচনে জয়ী হতে চলেছে। পিটিআইকে যারা ভোট দেবেন তাদের ৮৩ শতাংশই মনে করছে পিটিআই অধিক আসনে জয় পাবে। মাত্র সাড়ে ১২ শতাংশ মনে করছে মুসলিম লীগ আবারো বেশি আসনে জয় লাভ করবে। কিন্তু মুসলিম লীগকে যারা ভোট দেবে বলে জানিয়েছে তাদের মধ্যে সাড়ে ৫২ শতাংশের বিশ্বাস দলটি এবার বেশি আসন পাবে। অন্য দিকে তাদের ৪১ শতাংশের ধারণা পিটিআই এবার অধিক আসনে জয় পেতে পারে। পিপিপিকে যারা ভোট দেবেন তাদের মধ্যে সাড়ে ৪৩ শতাংশ পিটিআই, সাড়ে ২১ শতাংশ মুসলিম লীগ এবং সাড়ে ৩০ শতাংশ পিপিপি সরকার গঠন করবে বলে মনে করে। সার্বিকভাবে সকল বয়সের ভোটারদের বেশিরভাগের ধারণা এবার পিটিআই পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে জিততে যাচ্ছে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কারা কেমন প্রভাব বিস্তার করে এ নিয়ে জরিপে যে ফলাফল পাওয়া গেছে সেটি বেশ দৃষ্টি আকর্ষণের মতো। ৩৪ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা মনে করে নির্বাচনে সেনা বাহিনীর বিরাট প্রভাব রয়েছে। তাদের কোন প্রভাব নেই এমনটা মনে করে মাত্র ১৭ শতাংশ। বাকিরা বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাব রয়েছে বলে বিশ্বাস করে। বিচার বিভাগের নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে এমনটি মনে করেন ২৬ শতাংশ মানুষ। আর একবারে প্রভাব নেই মনে করেন সাড়ে ১৬ শতাংশ। বাকিরা বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাব রয়েছে বলে বিশ্বাস করে। নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষণা এবং কারাদন্ড প্রদানের ঘটনার কারণে মানুষের মধ্যে বিচার বিভাগের নির্বাচনে প্রভাব সম্পর্কে ধারণা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঐতিহ্যগতভাবে নির্বাচনে গণমাধ্যমের বিশেষ প্রভাব থাকে। তবে বড় রকমের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন ২৩ শতাংশের মতো উত্তরদাতা। আর একেবারে কোন প্রভাব নেই মনে করেন ৬ শতাংশ লোক। আনুষ্ঠানিক গণমাধ্যমের চেয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্বাচনকে এখন বেশি প্রভাবিত করছে। ২৯ শতাংশ মনে করেন বড় রকমের প্রভাব বিস্তার করে সামাজিক গণমাধ্যম। আর একেবারে প্রভাব নেই মনে করেন ৫ শতাংশের কিছু বেশি লোক।
নির্বাচনে জয় পরাজয়ের পেছনে জনসমর্থনের বাইরেও কিছু বিষয় কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মেরুকরণ, নানা ধরনের দুর্বলতায় আক্রান্ত রাজনীতিবিদদের প্রতি নানা উপায়ে বার্তা প্রদান, নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর প্রভাব সৃষ্টি, নির্বাচনে অংশ নেবার উপর বিধি নিষেধ জারি ইত্যাদি। এসব প্রক্রিয়া এবার কোনভাবেই মুসলিম লীগের পক্ষে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে পরাজয়ের মূল্য দেবার দিকেই এগুচ্ছে বলে মনে হয় শরীফ পরিবার ও তাদের দল মুসলিম লীগ। আগের দু’বারের মতো সেখান থেকে তারা কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেটিই দেখার বিষয়।